কনডম কিভাবে পড়তে হয়

কনডম কিভাবে পড়তে হয় — জানুন সঠিক ও নিরাপদ উপায়

আমাদের সমাজে যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা আজও এক প্রকার নিষিদ্ধ বা ‘ট্যাবু’। বিশেষ করে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বা কনডম ব্যবহারের বিষয়ে অনেকেই সঠিক তথ্য জানেন না। ফার্মেসিতে গিয়ে এটি কিনতেও অনেকে লজ্জা পান। আর এই লজ্জা ও অজ্ঞতার কারণেই আমাদের দেশে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ এবং যৌনবাহিত রোগের (STD) হার কমছে না।

অনেক দম্পতি বা তরুণ-তরুণী কনডম ব্যবহার করার পরেও ব্যর্থ হন (Condom Failure)। এর মূল কারণ কনডমটি খারাপ ছিল না, বরং তাদের ব্যবহারের পদ্ধতিটি ভুল ছিল

আজকের এই ব্লগে আমরা কোনো সংকোচ ছাড়াই, সম্পূর্ণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় জানব—কনডম কী, এটি কেন ব্যবহার করবেন, এটি পরার সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কী এবং ব্যবহারের সময় কী কী ভুল এড়িয়ে চলবেন। মনে রাখবেন, এটি কেবল একটি পণ্য নয়, এটি আপনার এবং আপনার সঙ্গীর সুরক্ষার কবচ।

কনডমের ধরন:

কনডম প্রধানত দুই ধরনের হয়:

  1. পুরুষ কনডম: এটি ল্যাটেক্স বা পলিইউরিথিন দিয়ে তৈরি এবং পুরুষাঙ্গে পরানো হয়।
  2. মহিলা কনডম: এটি নরম প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এবং যোনির ভেতরে রাখা হয়।

কনডম কেন ব্যবহার করবেন? (Importance of Condom Use)

কনডম হলো রাবার বা ল্যাটেক্সের তৈরি একটি পাতলা আবরণ, যা যৌন মিলনের সময় পুরুষের লিঙ্গে পরিধান করা হয়। এটি ব্যবহারের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে:

১. জন্মনিয়ন্ত্রণ (Birth Control): এটি শুক্রাণুকে জরায়ুতে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে এটি গর্ভধারণ রোধে ৯৮% পর্যন্ত কার্যকর। পিল বা ইনজেকশনের মতো এর কোনো হরমোরাল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
২. রোগ প্রতিরোধ (STD Protection): এটিই একমাত্র জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যা এইচআইভি (HIV), সিফিলিস, গনোরিয়া এবং হেপাটাইটিস বি-এর মতো মারাত্মক যৌনবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করে।

ব্যবহারের আগে: সঠিক কনডম বাছাই ও প্রস্তুতি

কনডম পরার আগে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ আছে, যা অনেকেই এড়িয়ে যান। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগুলো জানা জরুরি।

১. মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেখা (Check Expiry Date)

খাবারের মতো কনডমেরও একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। মেয়াদ পার হয়ে গেলে ল্যাটেক্স দুর্বল হয়ে যায় এবং ব্যবহারের সময় ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই প্যাকেট খোলার আগে অবশ্যই তারিখ দেখে নিন।

২. সঠিক সাইজ বা মাপ

কাপড়ের মতো কনডমেরও সাইজ আছে। খুব ছোট হলে ফেটে যেতে পারে, আবার খুব বড় হলে খুলে পড়ে যেতে পারে। সাধারণত ‘রেগুলার’ সাইজ সবার জন্য মানানসই হয়, তবে প্রয়োজনে বড় বা ছোট সাইজ বেছে নেওয়া যায়।

৩. ল্যাটেক্স অ্যালার্জি

অনেকের রাবার বা ল্যাটেক্সে অ্যালার্জি থাকে। ব্যবহারের পর যদি চুলকানি বা জ্বালাপোড়া হয়, তবে বুঝতে হবে ল্যাটেক্স অ্যালার্জি আছে। সেক্ষেত্রে ‘পলিইউরেথেন’ (Polyurethane) বা নন-ল্যাটেক্স কনডম ব্যবহার করতে হবে।

৪. সংরক্ষণের নিয়ম

অনেকে কনডম মানিব্যাগে বা পকেটে রাখেন। এটি মারাত্মক ভুল। শরীরের তাপ এবং ঘর্ষণে কনডম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এটি সবসময় ঠান্ডা ও শুষ্ক জায়গায় রাখা উচিত।

কনডম কিভাবে পড়তে হয়: ধাপে ধাপে কনডম পরার সঠিক নিয়ম

কনডম ব্যবহারের কার্যকারিতা পুরোপুরি নির্ভর করে এটি কতটা সঠিকভাবে পরা হয়েছে তার ওপর। নিচে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ধাপগুলো দেওয়া হলো:

ধাপ ১: প্যাকেট খোলা (Opening the Package)

  •         সতর্কতা: কখনোই দাঁত দিয়ে, কাঁচি দিয়ে বা নখ দিয়ে প্যাকেট ছিঁড়বেন না। এতে ভেতরের কনডমটি ফুটো হয়ে যেতে পারে।
  •         নিয়ম: প্যাকেটের এক কোণায় খাঁজ কাটা থাকে। হাত দিয়ে আলতো করে সেই খাঁজ বরাবর ছিঁড়ে ফেলুন। কনডমটি বের করার সময় নখ যেন না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখুন।

ধাপ ২: দিক নির্ধারণ (Check the Direction)

এটি সবচেয়ে সাধারণ ভুল। কনডমটি বের করার পর দেখতে হবে এটি কোন দিকে খোলে।

  •         এটি দেখতে অনেকটা টুপির মতো হবে। এর রিং বা কিনারাটি বাইরের দিকে গোটানো থাকবে।
  •         যদি দেখেন রিংটি ভেতরের দিকে, তবে বুঝবেন এটি উল্টো। উল্টো অবস্থায় এটি পরানো যাবে না। যদি ভুল করে উল্টো দিকে লাগানোর চেষ্টা করেন, তবে সেটি ফেলে দিয়ে নতুন একটি নিন (কারণ সেটিতে ইতিমধ্যে প্রাক-বীর্য বা জীবাণু লেগে থাকতে পারে)।

ধাপ ৩: বাতাস বের করা (Pinch the Tip)

কনডমের মাথায় একটি ছোট জায়গা বা থলি থাকে, যাকে ‘রিজার্ভার টিপ’ (Reservoir Tip) বলে। বীর্যপাতের পর বীর্য এখানে জমা হয়।

  •         নিয়ম: লিঙ্গে পরানোর আগে তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে এই টিপ বা আগাটি চিপে ধরে বাতাস বের করে দিন।
  •         কেন জরুরি: ভেতরে বাতাস থাকলে বীর্যপাতের চাপে কনডমটি ফেটে যেতে পারে।

ধাপ ৪: লিঙ্গে পরানো (Rolling it on)

  •         কনডম সবসময় লিঙ্গ সম্পূর্ণ উত্থিত বা শক্ত (Erect) অবস্থায় পরাতে হবে। নরম অবস্থায় এটি পরানো যায় না এবং খুলে যাওয়ার ভয় থাকে।
  •         টিপ বা আগাটি চিপে ধরা অবস্থায় কনডমটি লিঙ্গের মাথায় স্থাপন করুন।
  •         এবার অন্য হাত দিয়ে আস্তে আস্তে রিংটি লিঙ্গের গোড়া পর্যন্ত (Base of the penis) নামিয়ে আনুন। এটি যেন খুব মসৃণভাবে গড়িয়ে নিচে নামে।

ধাপ ৫: লুব্রিকেন্ট বা পিচ্ছিলকারক ব্যবহার

যদিও কনডমে লুব্রিকেন্ট দেওয়া থাকে, তবুও অতিরিক্ত আরামের জন্য লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।

  •         সতর্কতা: কখনোই তেল জাতীয় লুব্রিকেন্ট (যেমন—ভ্যাসলিন, বেবি অয়েল, লোশন, নারিকেল তেল) ব্যবহার করবেন না। তেল ল্যাটেক্সকে দুর্বল করে দেয় এবং কনডম ছিঁড়ে যেতে পারে।
  •         পরামর্শ: সবসময় পানি-ভিত্তিক (Water-based) বা সিলিকন-ভিত্তিক লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করুন।

ব্যবহারের সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

১. লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করুন:

  • কনডম ব্যবহারের সময় বাড়তি আরামের জন্য জল-ভিত্তিক বা সিলিকন-ভিত্তিক লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করতে পারেন। তবে তেল-ভিত্তিক লুব্রিক্যান্ট (যেমন ভ্যাসলিন) ব্যবহার করবেন না, কারণ এটি কনডমের গুণগত মান নষ্ট করতে পারে।

২. যৌনমিলনের সময় সতর্ক থাকুন:

  • যৌনমিলনের সময় কনডম ছিঁড়ে গেছে কিনা খেয়াল করুন। যদি ছিঁড়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে নতুন একটি কনডম ব্যবহার করুন।

৩. একবারে একটি কনডম ব্যবহার করুন:

  • একাধিক কনডম ব্যবহার করলে ঘর্ষণ বেড়ে যেতে পারে, যা কনডম ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।

ব্যবহারের পর: খোলা ও ফেলার নিয়ম (Removal and Disposal)

মিলন শেষ হওয়ার পরেও কিছু নিয়ম মানতে হয়, নাহলে এতক্ষণের সব সতর্কতা বিফলে যেতে পারে।

ধাপ ১: সঠিক সময়ে বের করা

  •         বীর্যপাতের পর লিঙ্গ যখনও শক্ত থাকে, তখনই সঙ্গীর শরীর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। লিঙ্গ নরম হয়ে গেলে কনডম ভেতরে থেকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ধাপ ২: গোড়া ধরে বের করা

  •         বের হওয়ার সময় অবশ্যই কনডমের গোড়া (রিম বা রিং) হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হবে, যাতে এটি খুলে না যায় বা কোনো তরল চুইয়ে বাইরে না পড়ে।

ধাপ ৩: গিট দেওয়া

  •         শরীর থেকে নামানোর পর কনডমের খোলা মুখটি একটি গিট (Knot) দিয়ে বেঁধে দিন, যাতে ভেতরের তরল বাইরে না আসে।

ধাপ ৪: সঠিক জায়গায় ফেলা

  •         ব্যবহৃত কনডম কখনোই কমোডে ফেলে ফ্লাশ করবেন না। এতে ড্রেন জ্যাম হতে পারে এবং এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
  •         এটি একটি টিস্যু পেপার বা কাগজে মুড়িয়ে ময়লার ঝুড়িতে (Dustbin) ফেলুন।

কনডম ব্যবহারে ৭টি সাধারণ ভুল (Common Mistakes)

নিচের ভুলগুলোর কারণেই মূলত কনডম ফেটে যায় বা গর্ভধারণ হয়ে যায়:

১. দেরি করে পরা: মিলন শুরু করার কিছুক্ষণ পর কনডম পরা। মনে রাখবেন, বীর্যপাতের আগে যে পিচ্ছিল রস (Pre-cum) বের হয়, তাতেও শুক্রাণু থাকতে পারে। তাই শুরু থেকেই এটি পরতে হবে।
২. ডাবল কনডম ব্যবহার: অনেকে ভাবেন দুটি কনডম পরলে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যাবে। এটি ভুল। দুটি কনডমের ঘর্ষণে বরং দুটিই ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩. তেল ব্যবহার: ভ্যাসলিন বা লোশন ব্যবহার করা (আগেই বলা হয়েছে এটি ল্যাটেক্স নষ্ট করে)।
৪. বাতাস বের না করা: টিপের বাতাস বের না করলে ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৫. উল্টো করে পরা: উল্টো করে পরার চেষ্টা করে আবার সোজা করে পরা। এতে জীবাণু বা শুক্রাণু লেগে থাকতে পারে।
৬. নখ বা দাঁত লাগানো: প্যাকেট খোলার সময় অসাবধানতা।
৭. মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য: ডেট পার হয়ে যাওয়া কনডম ব্যবহার।

কনডম ফেটে গেলে কী করবেন? (Emergency Steps)

দুর্ভাগ্যবশত যদি মিলনের সময় কনডম ফেটে যায় বা ভেতরে রয়ে যায়, তবে আতঙ্কিত হবেন না।
১. তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা: অবিলম্বে মিলন বন্ধ করুন।
২. পরিষ্কার: সাবান পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ ধুয়ে ফেলুন (তবে নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ুর ভেতর ধোয়া বা ডুশ দেওয়া উচিত নয়, এতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে)।
৩. ইমার্জেন্সি পিল: অপরিকল্পিত গর্ভধারণ রোধ করতে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে (যত দ্রুত সম্ভব) ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল (Emergency Pill) সেবন করতে হবে। তবে এটি ডাক্তারের পরামর্শে নেওয়া ভালো।
৪. ডাক্তারের পরামর্শ: রোগ সংক্রমণের ভয় থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

কনডম কেন গুরুত্বপূর্ণ?

১. গর্ভনিরোধক পদ্ধতি:

  • কনডম ব্যবহারে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ রোধ করা যায়। এটি সহজলভ্য এবং ব্যয়বহুল নয়।

২. যৌন সংক্রমণ প্রতিরোধ:

  • কনডম এইচআইভি/এইডসসহ বিভিন্ন যৌন সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।

৩. সহজলভ্য এবং বহনযোগ্য:

  • কনডম ছোট এবং সহজে বহনযোগ্য। এটি যে কোনো সময় ব্যবহার করা যায়।

কনডম নিয়ে সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

কনডম কি ১০০% নিরাপদ?

উত্তর: চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনো পদ্ধতিই ১০০% নিরাপদ নয়। তবে সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে এটি ৯৮% পর্যন্ত কার্যকর। বাকি ২% ব্যর্থতা মূলত মানুষের ভুলের কারণেই হয়।

কনডম ব্যবহারে কি যৌন তৃপ্তি কমে যায়?

উত্তর: এটি একটি মানসিক ধারণা। বর্তমানে বাজারে অনেক পাতলা (Ultra-thin) কনডম পাওয়া যায় যা ব্যবহার করলে কোনো পার্থক্য বোঝা যায় না। বরং নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকলে মানসিক প্রশান্তির কারণে তৃপ্তি বাড়ে।

কনডম কি বারবার ব্যবহার করা যায়?

উত্তর: একদম না। একটি কনডম শুধুমাত্র একবারই ব্যবহারযোগ্য। প্রতিবার মিলনের জন্য নতুন কনডম ব্যবহার করতে হবে।

উপসংহার:

কনডম ব্যবহার কোনো লজ্জার বিষয় নয়, এটি একটি সচেতনতার বিষয়। এটি আপনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয় এবং মরণঘাতী রোগ থেকে বাঁচায়।

পরিবার পরিকল্পনা এবং সুস্থ যৌন জীবনের জন্য সঠিক নিয়মে কনডম ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। মানিব্যাগে দীর্ঘ দিন ফেলে রাখা কনডম ব্যবহার করবেন না, দাঁত দিয়ে প্যাকেট ছিঁড়বেন না এবং অবশ্যই লুব্রিকেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন।

আপনার একটু সচেতনতাই পারে আপনার এবং আপনার সঙ্গীর ভবিষ্যৎ সুন্দর রাখতে। সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন।

Scroll to Top