জরায়ুতে সিস্ট হলে কি হয়

জরায়ুতে সিস্ট হলে কি হয়? আলোচনা করা হলো

নারীদের জরায়ু (Uterus) বা ডিম্বাশয়ে (Ovary) সিস্ট একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি অনেকের কাছে আতঙ্কের বিষয়। অনেক নারী প্রশ্ন করেন — “জরায়ুতে সিস্ট হলে কি হয়?” আসলে সিস্ট বা গুটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, এবং সব ধরনের সিস্টই ক্ষতিকর নয়। তবে কিছু সিস্ট চিকিৎসা না করালে জটিলতা তৈরি করতে পারে। আজকের এই ব্লগে আমরা সহজ ভাষায় আলোচনা করবো— জরায়ুতে সিস্ট হলে কী হয়, এর লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা, খাবার ও যত্নের উপায়।

জরায়ুর সিস্ট কি?

জরায়ুর সিস্ট বলতে বোঝায় জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের ভেতরে ছোট ছোট থলির মতো গঠন, যা তরল পদার্থে ভর্তি থাকে। সাধারণত এগুলো Ovarian Cyst নামে পরিচিত। বেশিরভাগ সিস্ট ক্ষতিকর নয় এবং কিছু সময় পর নিজে থেকেই চলে যায়। তবে কিছু সিস্ট বড় হয়ে গেলে বা জটিলতা সৃষ্টি করলে চিকিৎসা প্রয়োজন।

জরায়ুতে সিস্ট কেন হয়?

সিস্ট হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। নিচে সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:

  1. হরমোনের ভারসাম্যহীনতা – শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের অসামঞ্জস্য থাকলে সিস্ট তৈরি হতে পারে।

  2. ডিম্বস্ফোটনজনিত সমস্যা – মাসিকের সময় ডিম্বাণু তৈরি হয়ে ডিম্বাশয় থেকে বের না হলে সেখানে সিস্ট তৈরি হতে পারে।

  3. পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) – ডিম্বাশয়ে একাধিক ছোট সিস্ট একসাথে তৈরি হলে এটিকে PCOS বলা হয়।

  4. সংক্রমণ বা ইনফেকশন – প্রজনন অঙ্গে সংক্রমণ হলে টিস্যুর ভেতর তরল জমে সিস্ট হতে পারে।

  5. বংশগত কারণ – পরিবারের কারও একই সমস্যা থাকলে সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কী কী লক্ষণ দেখা যায়?

সব ক্ষেত্রে সিস্টের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে বড় বা সক্রিয় সিস্ট হলে নিচের লক্ষণগুলো সাধারণত দেখা যায়:

  • নিচের পেটে বা কোমরে ব্যথা

  • মাসিক অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে যাওয়া

  • পেট ফেঁপে যাওয়া বা ভারী লাগা

  • যৌনমিলনের সময় ব্যথা

  • ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ

  • বমি বমি ভাব বা ক্ষুধামন্দা

  • ওজন বৃদ্ধি বা পেটের দিকে মেদ জমা

এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত একজন গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কি বিপদ হয়?

সব সিস্টই বিপজ্জনক নয়। তবে নিচের কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা জরুরি:

  • সিস্টের আকার ৫ সেন্টিমিটার বা তার বেশি হলে

  • সিস্ট ফেটে গেলে (Cyst rupture)

  • সিস্ট মোচড় খেলে (Torsion)

  • তীব্র ব্যথা বা রক্তপাত হলে

যদি সিস্ট ক্যান্সারজনিত হয় (Ovarian cancer), তবে তা জীবনঘাতী হতে পারে। তাই সঠিক পরীক্ষা ও সময়মতো চিকিৎসা অত্যন্ত প্রয়োজন।

জরায়ুতে সিস্টের ধরন:

১. ফাংশনাল সিস্ট (Functional Cyst): সবচেয়ে সাধারণ সিস্ট, যা সাধারণত ১-৩ মাসের মধ্যে নিজে থেকেই চলে যায়।

২. ডারময়েড সিস্ট (Dermoid Cyst): এতে চুল, চর্বি বা টিস্যু থাকে। অপারেশন ছাড়া এটি দূর হয় না।

৩. এন্ডোমেট্রিওটিক সিস্ট (Chocolate Cyst): জরায়ুর টিস্যু ডিম্বাশয়ে বেড়ে উঠলে এ সিস্ট হয়। এটি ব্যথাযুক্ত এবং চিকিৎসা প্রয়োজন।

৪. সিস্টাডেনোমা (Cystadenoma): এটি বড় হতে পারে এবং পেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়।

৫. পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS): হরমোনজনিত কারণে অনেক ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়। এটি বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কি হয়?

এটি নির্ভর করে সিস্টের ধরণ ও অবস্থার ওপর।

  • ফাংশনাল সিস্ট: সাধারণত ক্ষতিকর নয়, গর্ভধারণে সমস্যা হয় না।

  • PCOS: ডিম্বস্ফোটন বন্ধ থাকলে সন্তান ধারণে জটিলতা হয়।

  • এন্ডোমেট্রিওটিক বা চকলেট সিস্ট: এটি গর্ভধারণে বাধা দিতে পারে।

তবে সঠিক চিকিৎসা ও জীবনযাত্রা ঠিক রাখলে অনেক নারী সিস্ট থাকা সত্ত্বেও গর্ভবতী হতে পারেন।

জরায়ুতে সিস্ট নির্ণয়ের উপায়:

চিকিৎসক সাধারণত নিচের পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে সিস্ট নির্ণয় করেন:

  1. আল্ট্রাসনোগ্রাম (Ultrasound) – সিস্টের আকার ও অবস্থান নির্ণয় করা হয়।

  2. CT Scan বা MRI – জটিল সিস্ট নির্ণয়ে সহায়ক।

  3. রক্ত পরীক্ষা (CA-125) – ক্যান্সার সন্দেহ হলে এই টেস্ট করা হয়।

  4. হরমোন টেস্ট – PCOS বা হরমোনজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে।

জরায়ুতে সিস্ট চিকিৎসা পদ্ধতি:

১. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা

ছোট ও সাধারণ সিস্ট হলে চিকিৎসক হরমোন নিয়ন্ত্রণের ওষুধ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল দিতে পারেন। এগুলো মাসিক নিয়মিত করে ও নতুন সিস্ট তৈরি হতে বাধা দেয়।

২. অস্ত্রোপচার (Surgery)

যদি সিস্ট বড় হয়, ব্যথা দেয় বা ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে, তবে ল্যাপারোস্কোপি (Laparoscopy) করে অপারেশন করা হয়। এতে ক্ষুদ্র ছিদ্রের মাধ্যমে সিস্ট অপসারণ করা হয়।

৩. জীবনযাত্রার পরিবর্তন

সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও ওজন কমানো জরুরি। এগুলো সিস্টের ঝুঁকি কমায় এবং হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কী খাওয়া উচিত?

খাবারের তালিকা:

  • শাকসবজি ও ফলমূল (বিশেষ করে ব্রকলি, পেপে, আপেল)

  • উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার (ওটস, ব্রাউন রাইস, ডাল)

  • ভালো প্রোটিন (ডিম, মাছ, মুরগি)

  • পর্যাপ্ত পানি

যা এড়িয়ে চলবেন:

  • ফাস্ট ফুড, চর্বিযুক্ত খাবার

  • চিনি ও কোমল পানীয়

  • অতিরিক্ত কফি ও চা

  • ধূমপান ও অ্যালকোহল

জীবনযাত্রার যত্ন:

  • প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করুন।

     

  • পর্যাপ্ত ঘুম (৭-৮ ঘণ্টা) নিশ্চিত করুন।

     

  • মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করুন।

     

  • অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা করুন।

     

  • চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া কোনো ওষুধ খাবেন না।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?

নিচের যে কোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:

  • তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী পেটব্যথা

  • মাসিক অনিয়ম বা রক্তপাত

  • যৌনমিলনের সময় ব্যথা

  • হঠাৎ পেট ফুলে যাওয়া বা ভারী লাগা

জরায়ুতে সিস্ট হলে সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)

জরায়ুতে সিস্ট হলে কী কী লক্ষণ দেখা যায়?

জরায়ুতে সিস্ট হলে অনেক সময় নিচের পেটে ব্যথা, মাসিক অনিয়মিত হওয়া, পেট ফোলা, সহবাসে ব্যথা, প্রস্রাবের সমস্যা বা অস্বাভাবিক সাদা স্রাব হতে পারে। তবে ছোট সিস্ট হলে অনেক সময় কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কি বিপদ হয়?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের সিস্ট ক্ষতিকারক নয় এবং চিকিৎসা ছাড়াই চলে যায়। তবে বড় সিস্ট বা ফেটে গেলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ বা ব্যথা হতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ জরুরি।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কি বাচ্চা ধারণে সমস্যা হয়?

কিছু প্রকার সিস্ট যেমন “পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)” ডিম্বস্ফোটন বাধাগ্রস্ত করে, ফলে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং বাচ্চা ধারণ সম্ভব।

জরায়ুতে সিস্টের চিকিৎসা কীভাবে হয়?

চিকিৎসা নির্ভর করে সিস্টের আকার, ধরন ও উপসর্গের ওপর। ছোট সিস্ট হলে ওষুধ ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট। বড় বা জটিল সিস্ট হলে সার্জারি বা ল্যাপারোস্কোপিক অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে।

জরায়ুতে সিস্ট হলে কী খাওয়া উচিত?

হরমোন ভারসাম্য রাখতে শাকসবজি, ফলমূল, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (যেমন মাছ), প্রোটিনযুক্ত খাবার এবং ফাইবারসমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়া ভালো। চিনি, তেল-চর্বি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।

জরায়ুতে সিস্ট কি নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়?

হ্যাঁ, অনেক সময় ছোট আকারের সিস্ট স্বাভাবিকভাবে মাসিকের সঙ্গে সরে যায়। তবে বড় সিস্ট বা যেগুলো ব্যথা বা সমস্যা সৃষ্টি করছে, সেগুলোর চিকিৎসা দরকার।

জরায়ুতে সিস্ট প্রতিরোধ করা যায় কি?

সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা না গেলেও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং হরমোনজনিত সমস্যাগুলো দ্রুত চিকিৎসা করলে ঝুঁকি অনেক কমানো যায়।

জরায়ুতে সিস্ট কি ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে?

সাধারণত বেশিরভাগ সিস্ট ক্যান্সার নয় এবং নিরীহ। তবে বয়স বেশি হলে বা সিস্টের গঠন অস্বাভাবিক দেখালে ডাক্তারের মাধ্যমে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

জরায়ুতে সিস্ট হলে মাসিকের কী পরিবর্তন হয়?

মাসিক অনিয়মিত হতে পারে, কখনও খুব বেশি রক্তপাত বা কখনও অনেক দিন মাসিক না আসা—এমনও দেখা যায়। হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়াই এর মূল কারণ।

জরায়ুতে সিস্ট থাকলে কি অপারেশন ছাড়াই ভালো হওয়া যায়?

অনেক ক্ষেত্রেই অপারেশন ছাড়াই ওষুধ ও নিয়ম মেনে চললে সিস্ট ভালো হয়ে যায়। তবে যদি সিস্ট বড় হয়, ফেটে যায় বা টিউমারের মতো দেখা দেয়, তখন অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।

উপসংহার:

জরায়ুতে সিস্ট হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বেশিরভাগ সিস্ট নিজে থেকেই চলে যায়, তবে নিয়মিত চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন জরুরি। সঠিক খাদ্য, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে সিস্ট সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।

Scroll to Top