টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার লক্ষণ — ক্লান্তি, দুর্বলতা নাকি হরমোন সমস্যা?
বয়স ৩০ পার হতে না হতেই অনেক পুরুষ লক্ষ্য করেন যে তাদের আগের সেই শক্তি বা উদ্দীপনা আর নেই। সিড়ি দিয়ে উঠতে গেলে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন, কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে থাকছে এবং দাম্পত্য জীবনেও আসছে অনীহা। অনেকেই ভাবেন, “হয়তো বয়সের দোষ” বা “কাজের চাপে এমন হচ্ছে”।
কিন্তু সব সময় একে অবহেলা করা ঠিক নয়। এই লক্ষণগুলো মূলত পুরুষের শরীরের প্রধান হরমোন—টেস্টোস্টেরন (Testosterone) কমে যাওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘মেল হাইপোগোনাডিজম’ (Male Hypogonadism) বা পুরুষের হরমোন ঘাটতি।
আজকের এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানব, টেস্টোস্টেরন হরমোন আসলে কী, এটি কমে গেলে শরীরে কী কী পরিবর্তন দেখা দেয় এবং কীভাবে বুঝবেন আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন কি না।
টেস্টোস্টেরন হরমোন কি এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
সহজ কথায় বলতে গেলে, টেস্টোস্টেরন হলো পুরুষত্বের জ্বালানি। এটি একটি অ্যান্ড্রোজেন হরমোন যা মূলত পুরুষের অণ্ডকোষে (Testicles) তৈরি হয়। একজন কিশোর যখন পুরুষ হয়ে ওঠে, তার দাড়ি-গোঁফ গজানো, গলার স্বর ভারী হওয়া, পেশী সুগঠিত হওয়া—সবকিছুর পেছনেই থাকে এই হরমোনের ভূমিকা।
এর গুরুত্ব অপরিসীম:
১. যৌন স্বাস্থ্য: যৌন আকাঙ্ক্ষা বা লিবিডো নিয়ন্ত্রণ করে।
2. শারীরিক গঠন: পেশী ও হাড় মজবুত রাখে।
3. মানসিক স্বাস্থ্য: আত্মবিশ্বাস, মেজাজ এবং স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে।
4. চর্বি নিয়ন্ত্রণ: শরীরের মেদ জমতে বাধা দেয়।
সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে এই হরমোনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। এরপর প্রতি বছর এটি ধীরে ধীরে (প্রায় ১% করে) কমতে শুরু করে। কিন্তু বর্তমান লাইফস্টাইল ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে খুব অল্প বয়সেই অনেকের এই হরমোন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার লক্ষণ কি কি?
টেস্টোস্টেরন কমে গেলে শরীর এবং মনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। লক্ষণগুলো একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। তবে প্রধান ১০টি লক্ষণ নিচে আলোচনা করা হলো:
১. যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া (Low Libido)
এটি টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় এবং প্রাথমিক লক্ষণ।
- বিবরণ: পুরুষের যৌন মিলনের আগ্রহ বা তাড়না প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। কিন্তু হরমোন কমে গেলে হঠাৎ করেই এই আগ্রহে ভাটা পড়ে। সঙ্গীর প্রতি আকর্ষণ কমে যায় এবং যৌন মিলনের চিন্তাও মাথায় আসে না। এটি দাম্পত্য জীবনে দূরত্বের সৃষ্টি করে।
২. লিঙ্গ উত্থানে সমস্যা (Erectile Dysfunction)
টেস্টোস্টেরন হরমোন সরাসরি লিঙ্গ উত্থান করায় না, কিন্তু এটি মস্তিষ্কের রিসেপ্টরগুলোকে সংকেত দেয় নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে, যা উত্থানে সাহায্য করে।
- বিবরণ: হরমোন কমে গেলে লিঙ্গ যথেষ্ট শক্ত হয় না বা বেশিক্ষণ শক্ত থাকে না। এমনকি ঘুমের মধ্যে বা সকালে যে স্বতঃস্ফূর্ত ইরেকশন (Morning Wood) হওয়ার কথা, সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।
৩. সারাদিন ক্লান্তি ও অবসাদ (Extreme Fatigue)
আপনি কি পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরেও সকালে ক্লান্ত বোধ করেন? অফিসের কাজ করতে গিয়ে কি দুপুরের আগেই এনার্জি শেষ হয়ে যায়?
- বিবরণ: টেস্টোস্টেরন শরীরে এনার্জি লেভেল বজায় রাখে। এর ঘাটতি হলে মনে হয় শরীরে কোনো শক্তি নেই। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছা করে এবং কোনো কাজেই উৎসাহ পাওয়া যায় না।
৪. পেশী কমে যাওয়া (Loss of Muscle Mass)
পুরুষদের সুঠাম দেহের রহস্য হলো এই হরমোন।
- বিবরণ: আপনি হয়তো নিয়মিত জিমে যাচ্ছেন বা ব্যায়াম করছেন, কিন্তু পেশী বাড়ছে না; উল্টো আগের পেশীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে বা নরম হয়ে যাচ্ছে। টেস্টোস্টেরন কমে গেলে শরীর পেশী টিস্যু ধরে রাখতে পারে না।
৫. শরীরে চর্বি বাড়া ও ভুঁড়ি হওয়া (Increased Body Fat)
টেস্টোস্টেরন কমে গেলে পেশী কমে যায় এবং সেই জায়গায় চর্বি জমতে শুরু করে।
- বিবরণ: বিশেষ করে পেটের চর্বি বা ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়া এই হরমোন ঘাটতির একটি বড় লক্ষণ। আবার ভুঁড়ি বাড়লে সেখানে ‘অ্যারোমাটেজ’ এনজাইমের কারণে টেস্টোস্টেরন আরও কমে যায়—এটি একটি চক্রের মতো কাজ করে।
- গাইনোকোমাস্টিয়া (Gynecomastia): কিছু ক্ষেত্রে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ইস্ট্রোজেন (নারী হরমোন) বেড়ে যায়, ফলে পুরুষদের স্তন টিস্যু বড় হয়ে যেতে পারে।
৬. হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া (Weak Bones)
হাড়ের ঘনত্ব বা বোন ম্যাস (Bone Mass) ধরে রাখতে টেস্টোস্টেরন অপরিহার্য।
- বিবরণ: হরমোন কমে গেলে হাড়গুলো ভেতর থেকে ফাঁপা বা দুর্বল হয়ে যায় (Osteoporosis)। ফলে সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।
৭. চুল পড়া (Hair Loss)
যদিও টাক পড়ার পেছনে বংশগত কারণ (Genetics) প্রধান, তবুও টেস্টোস্টেরনের ভূমিকা আছে।
- বিবরণ: টেস্টোস্টেরন কমে গেলে বা এর রূপান্তর ঠিকমতো না হলে মাথার চুল পড়ে যেতে পারে। এছাড়া দাড়ি বা শরীরের লোমও পাতলা হয়ে যেতে পারে।
৮. ঘুমের সমস্যা (Sleep Disturbance)
- বিবরণ: শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। রাতে ঘুম আসতে দেরি হওয়া, বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া বা ইনসোমনিয়া দেখা দিতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’ (ঘুমের মধ্যে শ্বাস আটকে যাওয়া) সমস্যাও হতে পারে।
৯. মানসিক পরিবর্তন ও ডিপ্রেশন (Mood Swings)
টেস্টোস্টেরন শুধু শরীর নয়, মনকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
- বিবরণ: হরমোন কমে গেলে অকারণে মন খারাপ থাকা, ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। ছোটখাটো বিষয়েই রাগ হতে পারে। নিজেকে খুব একা এবং অসহায় মনে হতে পারে।
১০. স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ কমে যাওয়া (Cognitive Decline)
- বিবরণ: অনেক পুরুষ লক্ষ্য করেন যে তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না বা ছোটখাটো বিষয় ভুলে যাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টোস্টেরন মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তির সাথে সরাসরি জড়িত।
আরও টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণসমূহ:
✔️ বীর্যে স্পার্ম কমে যাওয়া
✔️ যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া
✔️ শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া
✔️ হাত-পা ঠান্ডা অনুভব
✔️ মাথাব্যথা
✔️ স্ট্রেস বেড়ে যাওয়া
✔️ সহজে হতাশ হওয়া
✔️ বুক ধড়ফড় করা
এই লক্ষণগুলোর মধ্যে আপনার যদি ৫টির বেশি লক্ষণ থাকে, তবে টেস্টোস্টেরন লেভেল পরীক্ষা করানো জরুরি।
কেন কমে যাচ্ছে টেস্টোস্টেরন? (Causes of Low Testosterone)
লক্ষণ তো জানলেন, কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে:
১. বয়স: এটি প্রাকৃতিক কারণ। ৩০ বছরের পর থেকে ধীরে ধীরে হরমোন কমতে থাকে।
২. অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: ব্যায়াম না করা, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়া এবং অলস জীবনযাপন।
৩. মানসিক চাপ (Stress): অতিরিক্ত টেনশন করলে শরীরে ‘কর্টিসল’ হরমোন বাড়ে, যা টেস্টোস্টেরন কমিয়ে দেয়।
৪. স্থূলতা (Obesity): অতিরিক্ত ওজন হরমোন তৈরির পথে বড় বাধা।
৫. রোগবালাই: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভারের সমস্যা বা কিডনি রোগ থাকলে হরমোন কমতে পারে।
৬. ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু স্টেরয়েড, পেইনকিলার বা অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ঔষধের কারণে এটি হতে পারে।
৭. প্লাস্টিকের ব্যবহার: প্লাস্টিকের বোতলে পানি খাওয়া বা প্লাস্টিক কন্টেইনার ব্যবহারে শরীরে রাসায়নিক ঢুকে হরমোনের ক্ষতি করে।
টেস্টোস্টেরন কমে গেছে কিনা জানতে কোন টেস্ট করতে হয়?
ওপরের লক্ষণগুলো দেখলেই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন না বা ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে খাবেন না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দেন।
- রক্ত পরীক্ষা (Serum Testosterone Test): এটি হলো প্রধান পরীক্ষা।
- কখন করবেন: টেস্টোস্টেরন লেভেল সকালবেলা (সকাল ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে) সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই সকালে খালি পেটে রক্ত দিয়ে এই পরীক্ষাটি করা সবচেয়ে উত্তম।
- নরমাল রেঞ্জ: সাধারণত রক্তে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ৩০০ থেকে ১০০০ ng/dL এর মধ্যে থাকলে তাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। ৩০০ এর নিচে হলে তাকে ‘Low Testosterone’ বা হরমোন ঘাটতি বলা হয়।
চিকিৎসকের পরামর্শ: এখন করণীয় কী? (Treatment & Solutions)
যদি পরীক্ষায় হরমোন কম ধরা পড়ে, তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সমাধান করা সম্ভব।
১. প্রাকৃতিক উপায় (Natural Ways)
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র লাইফস্টাইল পরিবর্তন করলেই হরমোন লেভেল বাড়ে।
- ওজন কমান: পেটের চর্বি কমালে হরমোন দ্রুত বাড়ে।
- ব্যায়াম: ভারী ব্যায়াম বা ওয়েট লিফটিং (Weight Lifting) এবং স্কোয়াট টেস্টোস্টেরন বুস্ট করতে সেরা।
- খাবার: জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার (গরুর মাংস, কলিজা, কুমড়ার বীজ, বাদাম), ভিটামিন ডি (ডিম, সামুদ্রিক মাছ) এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (ঘি, অলিভ অয়েল) খান।
- ঘুম: রাতে ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম নিশ্চিত করুন।
- চিনি বর্জন: মিষ্টি জাতীয় খাবার ও কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দিন।
২. মেডিকেল চিকিৎসা (Medical Treatment)
যদি প্রাকৃতিক উপায়ে কাজ না হয় এবং লেভেল খুব বেশি নিচে থাকে, তবে ডাক্তার TRT (Testosterone Replacement Therapy) এর পরামর্শ দিতে পারেন।
- এটি ইনজেকশন, জেল, প্যাচ বা ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে শরীরে হরমোন প্রবেশ করানো হয়।
- সতর্কতা: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই হরমোন ইনজেকশন বা পিল নেবেন না। এতে অণ্ডকোষ ছোট হয়ে যাওয়া, বন্ধ্যাত্ব এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে।
টেস্টোস্টেরন হরমোন নিয়ে সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
হরমোন কম থাকলে কি বাচ্চা হবে না?
কোন বয়সে টেস্টোস্টেরন চেক করা উচিত?
সয়াবিন খেলে কি টেস্টোস্টেরন কমে?
কখন অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন?
যদি—
- যৌন ইচ্ছা হঠাৎ কমে যায়
- উত্থান সমস্যায় ভুগছেন
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
- পেশী কমে যাচ্ছে
- ওজন দ্রুত বাড়ছে
তাহলে অবশ্যই এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা ইউরোলজিস্ট দেখানো উচিত।
উপসংহার:
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়া এখন আর বয়স্কদের সমস্যা নয়, এটি তরুণদের মধ্যেও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। শারীরিক দুর্বলতা, যৌন অনাগ্রহ বা মেজাজ খিটখিটে হওয়াকে অবহেলা করবেন না।
আপনার শরীর আপনাকে সংকেত দিচ্ছে, সেই সংকেত বুঝুন। লজ্জার খাতিরে লুকিয়ে না রেখে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ বা এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (Endocrinologist)-এর পরামর্শ নিন। সঠিক খাদ্যভ্যাস, ব্যায়াম এবং সচেতনতাই পারে আপনার পুরুষত্ব ও তারুণ্য ধরে রাখতে।
সুস্থ থাকুন, সচেতন হোন এবং নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিন।
(বিঃদ্রঃ এই ব্লগটি সাধারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা ও তথ্যের জন্য লেখা হয়েছে। আপনার যদি গুরুতর শারীরিক সমস্যা থাকে, তবে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।)


