
ডায়াবেটিস কত হলে ইনসুলিন নিতে হয়?
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ যা শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন বা ব্যবহারে সমস্যা তৈরি করে। কিছু ডায়াবেটিস রোগী শুধুমাত্র খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, আবার কিছু রোগীর ওষুধের প্রয়োজন হয়। তবে, অনেক ক্ষেত্রে ইনসুলিন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এই ব্লগে আমরা জানবো, ডায়াবেটিস কত হলে ইনসুলিন নিতে হয়, কেন ইনসুলিন দরকার হয়, এবং কীভাবে ইনসুলিন গ্রহণ করা উচিত।
ডায়াবেটিস এবং ইনসুলিনের সম্পর্ক:
আমাদের শরীরে খাবার গ্রহণের পর গ্লুকোজ তৈরি হয়, যা শক্তির প্রধান উৎস। এই গ্লুকোজ রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করলে অগ্ন্যাশয় (pancreas) থেকে ইনসুলিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা গ্লুকোজকে কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেয়।
✅ টাইপ ১ ডায়াবেটিস: অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তাই ইনসুলিন নেওয়া বাধ্যতামূলক।
✅ টাইপ ২ ডায়াবেটিস: শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। প্রাথমিক পর্যায়ে ওষুধ এবং খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সহায়ক হলেও, অনেক সময় ইনসুলিন নেওয়া প্রয়োজন হয়।
ডায়াবেটিস কত হলে ইনসুলিন নিতে হয়?
রক্তে শর্করার মাত্রার উপর ভিত্তি করে ইনসুলিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারিত হয়। সাধারণত:
✔ ফাস্টিং ব্লাড সুগার (খালি পেটে) ২০০ mg/dL বা তার বেশি হলে
✔ খাওয়ার পর (Postprandial) ব্লাড সুগার ৩০০ mg/dL এর বেশি হলে
✔ HbA1c ৯% বা তার বেশি হলে
✔ যখন ওষুধ কাজ করছে না এবং রক্তে সুগার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসছে না
✔ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন প্রয়োজন হতে পারে
✔ ডায়াবেটিসজনিত কিডনি, লিভার বা হার্টের সমস্যা হলে
কোন কোন ক্ষেত্রে ইনসুলিন বাধ্যতামূলক?
১. টাইপ ১ ডায়াবেটিস: জন্মগত বা কম বয়সে শুরু হওয়া টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের পুরোপুরি ইনসুলিনের উপর নির্ভর করতে হয়।
2. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: গর্ভবতী মায়েদের যদি ব্লাড সুগার মাত্রা খুব বেশি থাকে, তাহলে ইনসুলিন ছাড়া বিকল্প নেই।
3. অত্যন্ত উচ্চ সুগার মাত্রা: যখন ওষুধের সাহায্যে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না।
4. কিডনি ও লিভারের সমস্যা: দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস থাকলে কিডনি ও লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে, তখন ইনসুলিন নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
5. সার্জারির আগে ও পরে: কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে ইনসুলিন নেওয়া প্রয়োজন হয়।
ইনসুলিনের ধরন ও ব্যবহার:
ইনসুলিন বিভিন্ন ধরনের হয়, যা রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়:
✔ র্যাপিড-অ্যাক্টিং ইনসুলিন: খাবারের আগে নেওয়া হয়, এটি দ্রুত কাজ করে।
✔ শর্ট-অ্যাক্টিং ইনসুলিন: খাবারের পর কাজ করে এবং কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
✔ ইন্টারমিডিয়েট-অ্যাক্টিং ইনসুলিন: এটি ধীরে ধীরে কাজ করে এবং দীর্ঘক্ষণ কার্যকর থাকে।
✔ লং-অ্যাক্টিং ইনসুলিন: এটি ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারে এবং দিনে একবার নেওয়া হয়।
✅ ইনসুলিন কখন নিতে হয়?
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ইনসুলিন গ্রহণ করা উচিত।
- সাধারণত খাবারের আগে বা পরে ইনসুলিন নিতে হয়।
- ব্লাড সুগার নিয়মিত মনিটর করতে হয়।
ইনসুলিন নেওয়ার উপায়
ইনসুলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এটি সাধারণত ত্বকের নিচে ইনজেকশন হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
✅ ইনসুলিন নেওয়ার স্থান:
- পেটের চামড়ার নিচে
- বাহু
- উরুর অংশ
- নিতম্ব
✅ সঠিক নিয়ম:
- হাত পরিষ্কার করতে হবে
- সিরিঞ্জ বা ইনসুলিন পেন প্রস্তুত করতে হবে
- নির্ধারিত স্থানে ইনজেকশন দিতে হবে
- প্রতিবার ইনজেকশনের স্থান পরিবর্তন করতে হবে
- ব্যবহৃত সূঁচ ও সিরিঞ্জ নিরাপদ স্থানে ফেলতে হবে
ইনসুলিন নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
ইনসুলিন গ্রহণের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে:
✔ হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia): রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কমে গেলে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, হাত কাঁপা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
✔ ওজন বৃদ্ধি: অনেক ক্ষেত্রে ইনসুলিনের কারণে ওজন বেড়ে যেতে পারে।
✔ স্কিন রিঅ্যাকশন: ইনজেকশনের ফলে চামড়ায় কিছুটা লালচে দাগ হতে পারে।
✔ পেটের সমস্যা: কারো কারো ক্ষেত্রে হজমজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
✅ কীভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানো যায়?
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন ডোজ ঠিকমতো মেনে চলা
- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও নিয়মিত ব্যায়াম করা
- ব্লাড সুগার নিয়মিত পরীক্ষা করা
ইনসুলিন নেওয়া ছাড়া সুগার নিয়ন্ত্রণের উপায়:
যারা ইনসুলিন নেওয়া এড়াতে চান, তারা কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অনুসরণ করতে পারেন:
✔ সুষম খাদ্য গ্রহণ: কম কার্বোহাইড্রেট, বেশি ফাইবার ও প্রোটিনযুক্ত খাবার খান।
✔ নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটুন।
✔ পর্যাপ্ত পানি পান করুন: পর্যাপ্ত পানি পান করলে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকে।
✔ স্ট্রেস কমান: মানসিক চাপ কমালে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
✔ ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন: অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা কমানোর চেষ্টা করুন।
✔ নিয়মিত ব্লাড সুগার চেক করুন: নিয়মিত পরীক্ষা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
উপসংহার:
ডায়াবেটিস হলে অনেক ক্ষেত্রেই ইনসুলিন গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। যদি রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি থাকে, ওষুধ কাজ না করে, বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন নিতে হবে। তবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেক সময় ইনসুলিন ছাড়াই সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
✅ সঠিক চিকিৎসা নিন, সুস্থ থাকুন!