ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়:

ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা রক্তে শর্করার মাত্রার উপর প্রভাব ফেলে। এটি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রায়ই শোনা যায়, “ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?” এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, কারণ এটি বিভিন্ন কারণে নির্ভর করে। রক্তে শর্করার অত্যধিক বৃদ্ধি বা হ্রাস উভয়ই জীবননাশের কারণ হতে পারে। এই ব্লগে আমরা ডায়াবেটিসের মারাত্মক পরিস্থিতি এবং কীভাবে এটি এড়ানো যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

রক্তে শর্করার মাত্রা: কীভাবে এটি পরিমাপ করা হয়?

ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত রক্তে শর্করার মাত্রা মিলিগ্রাম পার ডেসিলিটার (mg/dL) এ পরিমাপ করা হয়। স্বাভাবিক রক্তে শর্করার মাত্রা হলো:

  • খালি পেটে: ৭০-১০০ mg/dL
  • খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর: ১৪০ mg/dL এর নিচে

যদি রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বা কম হয়, তখন তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া: রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কম হওয়া

হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলো সেই অবস্থা যখন রক্তে শর্করার মাত্রা ৭০ mg/dL এর নিচে নেমে যায়। এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • ঝিমঝিম ভাব
  • মাথা ঘোরা
  • ঘাম হওয়া
  • দ্রুত হৃদস্পন্দন
  • ঝাপসা দৃষ্টি
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

যদি হাইপোগ্লাইসেমিয়া দ্রুত সামলানো না হয়, তবে এটি কোমা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই, রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কমে গেলে দ্রুত চিনি, ফলের রস বা গ্লুকোজ ট্যাবলেট খাওয়া উচিত।

হাইপারগ্লাইসেমিয়া: রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি হওয়া

হাইপারগ্লাইসেমিয়া তখন হয় যখন রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। সাধারণত এটি ২০০ mg/dL এর উপরে হলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। হাইপারগ্লাইসেমিয়ার কারণে দুটি মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে:

১. ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (Diabetic Ketoacidosis – DKA)

ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস তখন ঘটে যখন শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না এবং শক্তি উৎপন্নের জন্য চর্বি ভাঙতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় কিটোন নামক একটি পদার্থ তৈরি হয়, যা রক্তে জমে অ্যাসিডিক পরিবেশ তৈরি করে। DKA এর লক্ষণগুলো হলো:

  • তীব্র পিপাসা
  • ঘন ঘন প্রস্রাব
  • বমি বমি ভাব
  • পেট ব্যথা
  • শ্বাসের সময় ফলের মতো গন্ধ
  • তন্দ্রাচ্ছন্নতা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

যদি DKA দ্রুত চিকিৎসা করা না হয়, তবে এটি জীবননাশের কারণ হতে পারে।

২. হাইপারসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট (Hyperosmolar Hyperglycemic State – HHS)

HHS একটি বিরল কিন্তু মারাত্মক অবস্থা যেখানে রক্তে শর্করার মাত্রা ৬০০ mg/dL এর বেশি হয়ে যায়। এটি সাধারণত টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। HHS এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • তীব্র পানিশূন্যতা
  • ত্বক শুষ্ক এবং উষ্ণ হয়ে যাওয়া
  • বিভ্রান্তি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
  • রক্তচাপ কমে যাওয়া

HHS একটি জরুরি অবস্থা যা দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।

ডায়াবেটিসে মৃত্যুর ঝুঁকির কারণগুলো:

ডায়াবেটিস নিজে থেকে মৃত্যুর কারণ নয়, তবে এর জটিলতা এবং নিয়ন্ত্রণের অভাব মৃত্যু ঘটাতে পারে। প্রধান কারণগুলো হলো:

১. হৃদরোগ এবং স্ট্রোক

ডায়াবেটিস হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়। দীর্ঘদিন ধরে রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে, যা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।

২. কিডনি বিকল হওয়া

ডায়াবেটিস কিডনির ক্ষতি করে, যা ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। কিডনি বিকল হলে তা জীবননাশের কারণ হতে পারে।

৩. স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি

ডায়াবেটিস স্নায়ুতন্ত্রে ক্ষতি করতে পারে, যা “ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি” নামে পরিচিত। এর ফলে পায়ে ঘা বা সংক্রমণ হতে পারে, যা কখনো কখনো পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।

৪. সংক্রমণ

ডায়াবেটিস রোগীদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা জীবাণুর বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়:

ডায়াবেটিসে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। আঁশযুক্ত খাবার বেশি খান।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন।
  • ওষুধ সঠিক সময়ে গ্রহণ: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন বা ওষুধ গ্রহণ করুন।
  • রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা: নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করুন এবং রেকর্ড রাখুন।
  • মানসিক চাপ কমানো: স্ট্রেস কমানোর জন্য মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করুন।

উপসংহার:

ডায়াবেটিস একটি গুরুতর কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি বা খুব কম হলে তা জীবননাশের কারণ হতে পারে। তাই, ডায়াবেটিস নিয়মিত পরীক্ষা করা, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা, এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।

Scroll to Top