ডেঙ্গু কি

ডেঙ্গু কি? - এর লক্ষণ ও প্রতিকার

আমরা অনেকেই জানি ডেঙ্গু কি? ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাসটি বহন করে এডিস মশা, বিশেষ করে এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশা। ডেঙ্গু সাধারণত গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষাকালে বেশি দেখা যায়, কারণ এ সময় মশার প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে ডেঙ্গু একটি সাধারণ এবং মাঝে মাঝে প্রাণঘাতী রোগ। তবে সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এটি এড়ানো সম্ভব। চলুন ডেঙ্গুর কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ, এবং করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

ডেঙ্গু কি ও ডেঙ্গুর কারণ

ডেঙ্গু রোগের প্রধান কারণ হলো ডেঙ্গু ভাইরাস। এই ভাইরাসের চারটি প্রধান ধরন রয়েছে: DENV-1, DENV-2, DENV-3, এবং DENV-4। এর মানে হলো, একজন ব্যক্তি জীবনে একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন, কারণ একবার সংক্রমণের পরেও অন্য ধরনের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

ডেঙ্গু মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং এরা মূলত জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে প্রজনন করে। তাই এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা ডেঙ্গু প্রতিরোধের একটি প্রধান উপায়।

ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ

ডেঙ্গু সংক্রমণের লক্ষণ সাধারণত ভাইরাসের সংক্রমণের ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলো হালকা থেকে মারাত্মক হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  1. উচ্চ জ্বর: ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ হলো জ্বর, যা ১০৪°F বা তার বেশি হতে পারে।
  2. মাথাব্যথা: বিশেষত চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হয়।
  3. পেশী এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা: এটি এতটাই তীব্র হয় যে একে “ব্রেকবোন ফিভার” বলা হয়।
  4. ত্বকের র‍্যাশ: শরীরে লালচে ফুসকুড়ি দেখা যায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই চুলকানির কারণ হয়।
  5. বমি বমি ভাব ও বমি: কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ক্ষুধামন্দা এবং বমি দেখা যায়।
  6. রক্তপাত: নাক, মাড়ি বা অন্যান্য স্থানে অল্প পরিমাণ রক্তক্ষরণ হতে পারে।

যদি ডেঙ্গু আরও গুরুতর হয়, তবে এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) এ রূপ নিতে পারে। এই অবস্থায় রক্তক্ষরণ, প্লাজমা লিকেজ, এমনকি অঙ্গ বিকল হতে পারে।

ডেঙ্গুর ধরণ

ডেঙ্গুর সংক্রমণ চারটি ধরণে হতে পারে:

  1. হালকা ডেঙ্গু ফিভার:
    • সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীতে ব্যথা, এবং র‍্যাশ।
    • সাধারণত গুরুতর নয় এবং ১-২ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
  2. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF):
    • রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে।
    • ত্বকের নিচে রক্ত জমে লালচে-নীলচে দাগ পড়ে।
    • সময়মতো চিকিৎসা না পেলে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
  3. ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS):
    • রক্তচাপ কমে যায়।
    • রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
  4. পুনরায় ডেঙ্গু সংক্রমণ:
    • একই ব্যক্তি জীবনে একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হলো মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ এবং মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ দেওয়া হলো:

১. জমে থাকা পানি পরিষ্কার করুন:

এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। তাই:

  • বাড়ির চারপাশে কোথাও পানি জমতে দেবেন না।
  • ফুলের টব, ফ্রিজের নিচের ট্রে, পুরনো টায়ার, বা পানির ট্যাঙ্কে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
  • মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল নষ্ট করুন।

২. মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন:

  • ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন।
  • মশা তাড়ানোর স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করুন।
  • দিনের বেলায় পুরো হাতা জামা ও লম্বা পায়জামা পরুন।
  • জানালা ও দরজায় নেট ব্যবহার করুন।

৩. বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন:

  • বাড়ির ভেতরে এবং বাইরের পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন।
  • মশা নিধনের জন্য ধূপ বা মশার কয়েল ব্যবহার করুন।

৪. সচেতনতা বাড়ান:

ডেঙ্গু সম্পর্কে নিজে জানুন এবং অন্যদের সচেতন করুন। বিশেষত যেসব এলাকায় ডেঙ্গু বেশি ছড়ায়, সেখানে মানুষকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করুন।

ডেঙ্গু হলে করণীয়

ডেঙ্গু হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রাথমিকভাবে আপনি যা করতে পারেন:

  1. প্রচুর পানি পান করুন: ডেঙ্গুতে শরীরে পানি শূন্যতা হতে পারে।
  2. তরল খাবার খাওয়ার পরিমাণ বাড়ান: ডাবের পানি, ফলের রস, এবং সুপ খাওয়া উপকারী।
  3. প্যারাসিটামল গ্রহণ করুন: জ্বর কমানোর জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল গ্রহণ করুন। অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন খাওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
  4. রোগীকে বিশ্রামে রাখুন: সম্পূর্ণ বিশ্রাম ডেঙ্গু থেকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।

ডেঙ্গু কি, ডেঙ্গু হলে সতর্কতা:

যদি নিচের কোনো লক্ষণ দেখা যায়, সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যান:

  • তীব্র পেট ব্যথা।
  • ক্রমাগত বমি।
  • গা ঢালা এবং দুর্বলতা।
  • নাক, মাড়ি বা ত্বক থেকে রক্তপাত।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনতা জরুরি

ডেঙ্গু কি, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করার চেয়ে এটি এড়ানো সহজ। তাই আপনার আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং মশার বংশবিস্তার রোধে সক্রিয় হোন। মনে রাখবেন, আপনার সামান্য সচেতনতাই পরিবার ও সমাজকে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করতে পারে।

ডেঙ্গু কি তথ্যসূত্র :

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)

  • ডেঙ্গু রোগের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC)

  • ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট, জ্বরের ধরন এবং রোগীর জন্য সতর্কতা ব্যবস্থা।

মায়ো ক্লিনিক (Mayo Clinic)

  • ডেঙ্গুর লক্ষণ, কারণ, এবং জ্বর ব্যবস্থাপনার তথ্য।

হেলথলাইন (Healthline)

  • ওয়েবসাইট: Healthline – Dengue Fever
  • ডেঙ্গুর লক্ষণ থেকে শুরু করে ঘরোয়া প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি পর্যন্ত তথ্য।

ডেঙ্গু নিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশি সোর্স

  • স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS):
  • বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি এবং রিপোর্ট।
  • আইইডিসিআর (IEDCR):
  • বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের পরিসংখ্যান ও সতর্কতামূলক তথ্য।

রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

  • ওয়েবসাইট: IFRC – Dengue
  • ডেঙ্গু মহামারী প্রতিরোধ এবং জরুরি ব্যবস্থাপনার তথ্য।

গবেষণা এবং শিক্ষা ভিত্তিক সোর্স

  • PubMed:
  • ডেঙ্গু নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ।
  • Google Scholar:
  • ওয়েবসাইট: Google Scholar – Dengue
  • ডেঙ্গু বিষয়ক শিক্ষামূলক গবেষণাপত্র।

বিভিন্ন ভাষায় তথ্য

  • ডেঙ্গু সম্পর্কে বাংলায় পড়ুন:
  • সহজ ভাষায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা।
Scroll to Top