ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ?
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা মশার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তবে, ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ, না এটি সরাসরি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে ছড়ায় না। অর্থাৎ, ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে, যা প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই (Aedes aegypti) এবং কিছু ক্ষেত্রে এডিস এলবোপিকটাস (Aedes albopictus) প্রজাতির মশা। এই মশাগুলো সাধারণত দিনে সক্রিয় থাকে, বিশেষত সকালে এবং সন্ধ্যায়।
ডেঙ্গুর ভাইরাসটির নাম ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV)। এই ভাইরাসের চারটি প্রধান ধরন রয়েছে: DENV-1, DENV-2, DENV-3, এবং DENV-4। একটি ধরন দ্বারা সংক্রমিত হলে শরীর কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু অন্য ধরনে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়।
ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর উপায় :
ডেঙ্গু রোগের প্রধান মাধ্যম হলো মশার কামড়। এটি ছড়ানোর প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে ঘটে:
- সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ:
এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তিকে কামড়ায় এবং সেই ব্যক্তির রক্তের সঙ্গে ভাইরাসটি মশার শরীরে প্রবেশ করে। - মশার শরীরে ভাইরাসের বৃদ্ধি:
মশার শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস কিছুদিন বৃদ্ধি পায় এবং মশাটি সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করে। - সংক্রমিত মশার কামড়:
সংক্রমিত মশাটি যখন একজন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন তার লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি নতুন ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ঘটায়।
ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ নয়
ডেঙ্গু সরাসরি একজন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে বা শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁচি-কাশি, স্পর্শ, বা ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে ছড়ায় না। তাই এটি ছোঁয়াচে রোগ নয়।
তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটতে পারে, যেমন:
- রক্ত দানের মাধ্যমে:
যদি কোনও ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং তার রক্ত অন্য কোনও ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, তবে সেই ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারেন। - অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে:
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে কোনও অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হলে নতুন ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারে। - গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন সংক্রমণ:
কোনও গর্ভবতী নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার গর্ভের সন্তান ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। এটি খুব বিরল ক্ষেত্রে ঘটে।
ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ:
ডেঙ্গুর লক্ষণগুলি সাধারণত সংক্রমণের ৪-১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। এর সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- জ্বর: উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর (১০৪°F বা তার বেশি)।
- মাথাব্যথা: বিশেষত চোখের পেছনে তীব্র ব্যথা।
- গাঁটে ও মাংসপেশিতে ব্যথা: এই ব্যথা এত তীব্র হয় যে একে কখনো কখনো “ব্রেকবোন ফিভার” বলা হয়।
- ত্বকে র্যাশ: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে লালচে দাগ বা র্যাশ দেখা দিতে পারে।
- বমি বমি ভাব ও বমি: রোগীরা প্রায়ই খাবারের প্রতি অনীহা অনুভব করেন।
- রক্তক্ষরণ: কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে, নাক বা মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়:
ডেঙ্গু রোগের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যায়:
- মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণ:
- ঘরের আশেপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা।
- ফ্রিজ বা এসি ট্রে নিয়মিত পরিষ্কার করা।
- মশা নিধনের স্প্রে ব্যবহার করা।
- নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করা:
- দিনে এবং রাতে দীর্ঘ হাতাওয়ালা পোশাক পরা।
- মশারি ব্যবহার করা।
- মশারোধী ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা।
- এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা:
- টায়ার, ফুলের টব, প্লাস্টিকের কন্টেইনার ইত্যাদিতে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া।
- পানির ট্যাংক ঢেকে রাখা।
- সচেতনতা বৃদ্ধি:
- ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো।
- স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ মেনে চলা।
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা:
ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- জ্বর নিয়ন্ত্রণ:
প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে জ্বর কমানো যায়। তবে অ্যাসপিরিন বা নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ এড়ানো উচিত, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়। - হাইড্রেশন:
প্রচুর পানি, ওরাল স্যালাইন, এবং তরল খাবার খাওয়া উচিত। - রোগীর বিশ্রাম:
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। - হাসপাতালে ভর্তি:
গুরুতর ক্ষেত্রে, যেমন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ডেঙ্গুর সামাজিক প্রভাব:
ডেঙ্গু শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উপর নয়, সমাজের উপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ডেঙ্গুর মহামারীকালীন সময়ে:
- হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে যায়।
- কর্মজীবী মানুষের কাজের ঘাটতি দেখা দেয়।
- আর্থিক ক্ষতি হয়।
তাই, ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু রোগের উপসংহার:
ডেঙ্গু একটি গুরুতর রোগ, কিন্তু ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ নয়। মশা হলো এই রোগের মূল বাহক। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ এবং নিজেকে সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব হলো সচেতন থাকা এবং ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
“সতর্ক থাকুন, নিরাপদ থাকুন।”