
ডেঙ্গু জ্বরের টেস্টের নাম ?
ডেঙ্গু জ্বরের সঠিক নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি টেস্ট করা হয়, যার মাধ্যমে জানা যায় রোগী ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত কি না। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের ডায়াগনোসিস নির্ভর করে রক্ত পরীক্ষা এবং ল্যাব টেস্ট এর উপর। নিচে ডেঙ্গু জ্বরের টেস্টের নাম গুলো সুন্দর করে দেয়া হলো।
ডেঙ্গু জ্বর কি?
ডেঙ্গু জ্বর DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4 এই চার ধরনের ভাইরাসের কারণে হয়। এডিস ইজিপ্টি বা এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশার কামড়ে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ডেঙ্গু জ্বরের কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- জ্বর (১০১°F থেকে ১০৪°F পর্যন্ত)
- মাথাব্যথা, বিশেষ করে চোখের পিছনে ব্যথা
- পেশি ও হাড়ে তীব্র ব্যথা (এজন্য একে “ব্রেকবোন ফিভার” বলা হয়)
- বমি বমি ভাব বা বমি
- ত্বকে র্যাশ (লাল দাগ)
- রক্তক্ষরণ (মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্ত পড়া, প্রেশার কমে যাওয়া)
ডেঙ্গু জ্বরের “ডেঙ্গু শক সিনড্রোম” (DSS) বা “হেমোরেজিক ডেঙ্গু” হলে এটি জীবনঘাতী হতে পারে। তাই সন্দেহ হলেই দ্রুত ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের টেস্টের নাম এগুলো হলো:
ডেঙ্গু জ্বর নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করা হয়। নিচে প্রধান ডেঙ্গু টেস্টগুলোর নাম ও বর্ণনা দেওয়া হলো:
১. NS1 Antigen Test (এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট)
- কখন করা হয়? জ্বর শুরু হওয়ার ১ম থেকে ৫ম দিনের মধ্যে এই টেস্ট করা হয়।
- কীভাবে কাজ করে? এই টেস্টে রক্তে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রোটিন (NS1) শনাক্ত করা হয়।
- সঠিকতা: প্রাথমিক পর্যায়ে (১-৩ দিনে) ৯০% নির্ভুল।
- ফলাফল:
- পজিটিভ হলে ডেঙ্গু নিশ্চিত।
- নেগেটিভ হলেও ডেঙ্গু বাদ দেওয়া যায় না (অন্য টেস্ট করতে হবে)।
২. Dengue IgM Antibody Test (ডেঙ্গু আইজিএম অ্যান্টিবডি টেস্ট)
- কখন করা হয়? জ্বর শুরুর ৪-৫ দিন পর থেকে এই টেস্ট করা যায়।
- কীভাবে কাজ করে? এটি রক্তে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া IgM অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে।
- সঠিকতা: ৭০-৯০% নির্ভুল (৫-৭ দিন পর সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়)।
- ফলাফল:
- পজিটিভ মানে সক্রিয় ডেঙ্গু সংক্রমণ।
- নেগেটিভ হলে অন্য টেস্ট (NS1 বা IgG) করতে হবে।
৩. Dengue IgG Antibody Test (ডেঙ্গু আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্ট)
- কখন করা হয়? সাধারণত ১০-১৪ দিন পর করা হয়।
- কীভাবে কাজ করে? এটি শরীরে দীর্ঘমেয়াদী অ্যান্টিবডি (IgG) শনাক্ত করে, যা দেখায় রোগী আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল কিনা।
- ফলাফল:
- পজিটিভ IgG + নেগেটিভ IgM = আগে ডেঙ্গু হয়েছিল (বর্তমানে নয়)।
- পজিটিভ IgG + পজিটিভ IgM = সম্প্রতি ডেঙ্গু হয়েছে।
৪. RT-PCR Test (আরটি-পিসিআর টেস্ট)
- কখন করা হয়? জ্বর শুরুর ১-৭ দিনের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর।
- কীভাবে কাজ করে? রক্তে ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনগত উপাদান (RNA) শনাক্ত করে।
- সঠিকতা: ৯৫-১০০% নির্ভুল (সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য)।
- সুবিধা: ভাইরাসের স্ট্রেইন (DEN-1, DEN-2 ইত্যাদি) শনাক্ত করা যায়।
- অসুবিধা: দাম বেশি (৩০০০-৬০০০ টাকা)।
৫. Complete Blood Count (CBC) – প্লেটলেট কাউন্ট
- কীভাবে সাহায্য করে? ডেঙ্গু জ্বরে প্লেটলেট কমে যায় (সাধারণত <১ লক্ষ)।
- WBC (শ্বেত রক্তকণিকা)ও কমতে পারে।
- হেমাটোক্রিট (HCT) বাড়লে ডিহাইড্রেশন বা প্লাজমা লিকেজের লক্ষণ।
কখন ডেঙ্গু টেস্ট করাবেন?
- প্রথম ১-৩ দিনে: NS1 Antigen Test বা RT-PCR (সবচেয়ে ভালো)।
- ৪-৭ দিন পর: IgM Antibody Test।
- ১০ দিন পর: IgG Antibody Test (যদি আগের টেস্ট নেগেটিভ আসে)।
- প্লেটলেট কমলে: CBC রিপোর্ট চেক করুন।
সতর্কতা: শুধু NS1 বা IgM নেগেটিভ আসলেই ডেঙ্গু নয়! লক্ষণ থাকলে ২-৩ দিন পর আবার টেস্ট করুন।
ডেঙ্গু টেস্টের খরচ (বাংলাদেশে):
টেস্টের নাম | খরচ (৳) |
NS1 Antigen Test | ৫০০-১০০০ |
IgM Antibody Test | ৮০০-১৫০০ |
IgG Antibody Test | ৮০০-১৫০০ |
RT-PCR Test | ৩০০০-৬০০০ |
CBC (প্লেটলেট কাউন্ট) | ২০০-৫০০ |
নোট: সরকারি হাসপাতালে সস্তায় টেস্ট করা যায় (২০০-৫০০ টাকায়)।
ডেঙ্গু টেস্ট কোথায় করাবেন?
বাংলাদেশে নিচে বর্ণিত জায়গাগুলোতে ডেঙ্গু টেস্ট করানো যায়:
- সরকারি হাসপাতাল (ডিএমসি, মিটফোর্ড, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ)।
- প্রাইভেট ল্যাব (প্রাগনা, ইউনাইটেড, ইবনে সিনা, ল্যাবএইড, পপুলার ডায়াগনস্টিক)।
- মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ।
ডেঙ্গু টেস্টের প্রস্তুতি:
- খালি পেটে যেতে হবে? না, ডেঙ্গু টেস্টের জন্য খালি পেটের প্রয়োজন নেই।
- কতটা রক্ত নেয়? সাধারণত ২-৫ মিলি রক্ত নেওয়া হয়।
- ফলাফল পেতে কত সময়?
- NS1/IgM: ১-৩ ঘণ্টা।
- RT-PCR: ৬-২৪ ঘণ্টা।
ডেঙ্গু টেস্টের ফলাফল বুঝবেন কীভাবে?
টেস্ট | পজিটিভ | নেগেটিভ |
NS1 | সক্রিয় ডেঙ্গু | ডেঙ্গু নাও হতে পারে (IgM চেক করুন)। |
IgM | বর্তমানে ডেঙ্গু | সম্ভবত ডেঙ্গু নয় (NS1/RT-PCR চেক করুন)। |
IgG | আগে ডেঙ্গু ছিল | কখনো ডেঙ্গু হয়নি। |
RT-PCR | ডেঙ্গু নিশ্চিত | ডেঙ্গু নেই। |
গুরুত্বপূর্ণ: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া টেস্ট রিপোর্ট নিজে থেকে বিশ্লেষণ করবেন না।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা:
- প্যারাসিটামল (জ্বর ও ব্যথার জন্য), এসপিরিন/ব্রুফেন নয় (রক্তক্ষরণের ঝুঁকি)।
- পানিশূন্যতা রোধে ওরাল স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস।
- প্লেটলেট <২০,০০০ হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
ডেঙ্গু টেস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ:
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সাধারণত অন্যান্য ভাইরাল ফিভারের মতোই হতে পারে। তাই, সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য এই টেস্টগুলি গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু সনাক্ত না হলে বা সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে রোগীর অবস্থা গুরুতর হতে পারে। বিশেষ করে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) রোগীর জন্য মারাত্মক হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ:
- হঠাৎ উচ্চ জ্বর
- তীব্র মাথাব্যথা
- চোখের পেছনে ব্যথা
- পেশি ও গাঁটের ব্যথা
- চামড়ার ওপর লালচে দাগ
- বমি বমি ভাব বা বমি করা
- প্লেটলেট সংখ্যা কমে যাওয়া
ডেঙ্গু টেস্ট করার সময় সতর্কতা:
১. প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। লক্ষণগুলো বোঝার পর চিকিৎসক সঠিক টেস্টের পরামর্শ দেবেন।
২. নির্ভরযোগ্য এবং সনদপ্রাপ্ত ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করান।
৩. টেস্টের রিপোর্ট যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়:
১. মশার কামড় থেকে সুরক্ষা:
- মশারী ব্যবহার করুন।
- ঘুমানোর সময় মশা নিরোধক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করুন।
২. পানি জমতে না দেওয়া:
- ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, এবং অন্য যেকোনো জায়গায় পানি জমতে না দিন।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:
- আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন।
- মশা নিরোধক ধোঁয়া ব্যবহার করুন।
কিছু সচরাচর প্রশ্ন (FAQ):
১. ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ আসলে কি ডেঙ্গু নয়?
না, প্রথম দিকে NS1/IgM নেগেটিভ আসতে পারে। লক্ষণ থাকলে ২-৩ দিন পর আবার টেস্ট করুন।
২. ডেঙ্গু হলে কতদিন পর প্লেটলেট কমে?
সাধারণত ৪-৭ দিন পর প্লেটলেট কমতে শুরু করে।
৩. ডেঙ্গু একবার হলে আবার হতে পারে?
হ্যাঁ, ডেঙ্গু ৪ টাইপের (DEN-1,2,3,4)। একবার এক টাইপ হলে পরে অন্য টাইপে আক্রান্ত হতে পারেন।
৪. ডেঙ্গু টেস্টের জন্য সকালে যেতে হবে?
না, যেকোনো সময় রক্ত দিতে পারবেন।
উপসংহার:
ডেঙ্গু জ্বর একটি মারাত্মক রোগ, তাই লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত NS1 বা IgM টেস্ট করান। তবে সঠিক সময়ে টেস্ট এবং চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণরূপে নিরাময় সম্ভব। ডেঙ্গু টেস্ট সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। তাই, লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং টেস্ট করান। মশা নিয়ন্ত্রণে সচেতন থাকুন এবং নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখুন।
সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন!