ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে

ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে ?

ডেঙ্গু জ্বর মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি সাধারণত এডিস ইজিপ্টাই বা এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ডেঙ্গু সাধারণত গ্রীষ্মপ্রধান এবং উষ্ণ জলবায়ুতে বেশি দেখা যায়।

ডেঙ্গু জ্বর কি?

ডেঙ্গু জ্বর হলো ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। এটি সাধারণত এডিস মশার কামড় থেকে সংক্রমিত হয়, যা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত চারটি ভাইরাস স্ট্রেইনের (DENV-1, DENV-2, DENV-3, DENV-4) মাধ্যমে হতে পারে। এটি মানুষের শরীরে প্রবেশের পর বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়।

ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে?

ডেঙ্গু জ্বরের স্থায়িত্ব রোগীর শারীরিক অবস্থা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল নিম্নরূপ:

১. সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর (Classic Dengue Fever)

  • জ্বরের স্থায়িত্ব: ৫-৭ দিন
  • রোগের পর্যায়:
    • প্রাথমিক পর্যায় (১-৩ দিন): হঠাৎ উচ্চ জ্বর (১০৩-১০৪°F), মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা।
    • ক্রিটিক্যাল ফেজ (৪-৭ দিন): জ্বর কমে গিয়ে রক্তের প্লেটলেট কমতে পারে, র্যাশ দেখা দেয়।
    • রিকভারি ফেজ (৭ দিন পর): ধীরে ধীরে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।

২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF)

এটি সাধারণ ডেঙ্গুর চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।

  • জ্বরের স্থায়িত্ব: ৭-১০ দিন
  • লক্ষণ:
    • তীব্র পেটে ব্যথা
    • বমি বা রক্তবমি
    • মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্ত পড়া
    • প্লেটলেট কাউন্ট কমে যাওয়া (<১ লাখ)

৩. ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)

এটি সবচেয়ে ভয়ানক পর্যায়, যেখানে রক্তচাপ কমে যায় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে।

  • জ্বরের স্থায়িত্ব: ১০-১৪ দিন বা তার বেশি
  • ঝুঁকি: মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ:

ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
✔️ হঠাৎ উচ্চ জ্বর (১০৪°F পর্যন্ত)
✔️ তীব্র মাথাব্যথা (বিশেষ করে চোখের পিছনে ব্যথা)
✔️ পেশি ও হাড়ে ব্যথা (হাড়ভাঙ্গা জ্বর নামেও পরিচিত)
✔️ শরীরে লাল র্যাশ (২-৫ দিন পর দেখা দেয়)
✔️ বমি বমি ভাব বা বমি
✔️ দুর্বলতা ও ক্লান্তি

⚠️ বিপদসংকেত (তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখান):

  • পেটে তীব্র ব্যথা
  • শ্বাসকষ্ট
  • রক্তবমি বা কালো পায়খানা
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা:

ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়:

১. মেডিক্যাল চিকিৎসা

  • প্যারাসিটামল: জ্বর ও ব্যথা কমাতে (অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন এড়িয়ে চলুন, এগুলো রক্তক্ষরণ বাড়ায়)।
  • পানিশূন্যতা রোধ: ORS, ডাবের পানি, ফলের রস।
  • হাসপাতালে ভর্তি: যদি প্লেটলেট কমে যায় (<৫০,০০০) বা রক্তক্ষরণ হয়।

২. ঘরোয়া চিকিৎসা

  • Papaya leaf juice: প্লেটলেট বাড়াতে সাহায্য করে।
  • তুলসী ও আদা চা: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম: দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।

ডেঙ্গু জ্বরের পর প্লেটলেট কাউন্ট কত হলে ঝুঁকি?

  • সাধারণ প্লেটলেট: ১.৫-৪ লাখ/μL
  • ঝুঁকিপূর্ণ: <১ লাখ
  • ভয়ানক অবস্থা: <২০,০০০ (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা)

প্লেটলেট বাড়ানোর উপায়:

  • পানি ও তরল খাবার বেশি খান
  • পেঁপে পাতার রস পান করুন
  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (আমলকী, লেবু) খান

ডেঙ্গু জ্বরের কারণ:

ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান কারণ হলো ডেঙ্গু ভাইরাস (Dengue Virus)। এই ভাইরাসটি মূলত এডিস ইজিপ্টাই (Aedes aegypti) নামক একটি স্ত্রী মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে।

বিস্তারিতভাবে ডেঙ্গু জ্বরের কারণ:

  1. ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) – এই ভাইরাসের ৪টি প্রকারভেদ (serotypes) রয়েছে: DENV-1, DENV-2, DENV-3, এবং DENV-4।

  2. মধ্যস্থ মশা – Aedes aegypti এবং কিছু ক্ষেত্রে Aedes albopictus মশাও এই ভাইরাস বহন করে।

  3. মশার কামড় – ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি যখন মশার কামড় খায়, তখন সেই মশা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। পরে সেই মশা অন্য কাউকে কামড় দিলে সেই ব্যক্তিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:

  • এই মশাগুলো সাধারণত ভোর ও সন্ধ্যাবেলায় বেশি সক্রিয় থাকে।

  • পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে (যেমন ফুলের টব, টায়ার, বালতি ইত্যাদি) এই মশা ডিম পাড়ে।

ডেঙ্গু জ্বর থেকে কীভাবে বাঁচা যায়?

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত:

  1. মশার কামড় এড়াতে মশারি ব্যবহার করুন।
  2. দিনের বেলায় ফুলহাতা জামা ও লম্বা প্যান্ট পরুন।
  3. মশা তাড়ানোর স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করুন।
  4. বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলুন।
  5. প্রতিদিন বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার রাখুন।

ডেঙ্গু জ্বরে কী করবেন?

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে নিচের বিষয়গুলো অনুসরণ করুন:

  • প্রচুর পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন।
  • প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করুন (ডাক্তারের পরামর্শে)।
  • সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিন।
  • রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ নিয়মিত পরীক্ষা করুন
  • অতিরিক্ত অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

ডেঙ্গু জ্বর কতটা বিপজ্জনক?

ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত জীবনঘাতী নয়। তবে যদি এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে পরিণত হয়, তাহলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া উচিত।

কিছু সচরাচর প্রশ্ন (FAQ):

১. ডেঙ্গু জ্বর একবার হলে আবার হতে পারে?

হ্যাঁ, ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ আছে। একবার এক টাইপে আক্রান্ত হলে শুধু সেই টাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।

২. ডেঙ্গু জ্বরে কি অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে?

না, ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর।

৩. ডেঙ্গু জ্বর কি ছোঁয়াচে?

না, এটি সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। শুধু মশার কামড়ে সংক্রমণ হয়।

উপসংহার:

ডেঙ্গু জ্বর একটি গুরুতর সংক্রামক রোগ হলেও সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং মশার কামড় এড়াতে সতর্ক থাকুন। ডেঙ্গুর কোনো টিকা বা নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তাই প্রতিরোধই এর সবচেয়ে ভালো উপায়।

সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন!