ডেঙ্গু জ্বর হলে কি ঔষধ খেতে হবে

ডেঙ্গু জ্বর হলে কি ঔষধ খেতে হবে?

ডেঙ্গু জ্বর বর্তমানে আমাদের দেশে একটি সাধারণ এবং গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। ডেঙ্গু ভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি দ্রুত ছড়ানোর কারণে সময়মতো চিকিৎসা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। ডেঙ্গু জ্বর হলে কোন ঔষধ খাওয়া উচিত এবং কীভাবে এটি মোকাবিলা করা যায় তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগে আমরা সহজ ভাষায় ডেঙ্গু জ্বরের ঔষধ এবং সঠিক যত্নের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

ডেঙ্গু জ্বর কি?

ডেঙ্গু জ্বর DEN-1, DEN-2, DEN-3 এবং DEN-4 নামক চার ধরনের ভাইরাসের কারণে হয়। এডিস ইজিপ্টি বা এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশার কামড়ে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত ৩ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয় এবং এর তীব্রতা রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ:

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত মশা কামড়ানোর ৪ থেকে ১০ দিন পর দেখা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

  1. হঠাৎ উচ্চ জ্বর (১০৪°F পর্যন্ত)
  2. মাথাব্যথা, বিশেষ করে চোখের পিছনে ব্যথা
  3. পেশী ও হাড়ে তীব্র ব্যথা (এজন্য একে “ব্রেকবোন ফিভার” বলা হয়)
  4. বমি বমি ভাব বা বমি
  5. ত্বকে লাল র্যাশ (২-৫ দিন পর দেখা দেয়)
  6. ক্ষুধামন্দা
  7. ক্লান্তি ও দুর্বলতা

কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর “ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার” (DHF) বা “ডেঙ্গু শক সিনড্রোম” (DSS)-এ রূপ নিতে পারে, যা জীবনঘাতী হতে পারে। এ ধরনের জটিলতায় নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দেয়—

  • তীব্র পেটে ব্যথা
  • মাড়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া
  • প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া
  • শরীরে পানি চলে আসা (শক সিনড্রোম)

ডেঙ্গু জ্বরে করণীয়:

ডেঙ্গু হলে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। রোগীর অবস্থা বুঝে প্রাথমিকভাবে কিছু সাধারণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  1. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখা উচিত।
  2. শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখা: ডেঙ্গু জ্বরে শরীর ডিহাইড্রেট হয়ে যায়। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, নারকেলের পানি, স্যুপ এবং তরল খাবার খাওয়ানো উচিত।
  3. জ্বর নিয়ন্ত্রণ: জ্বর নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণত প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হয়। তবে কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক (যেমন আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিন) খাওয়া উচিত নয়, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  4. প্লেটলেট পর্যবেক্ষণ: ডেঙ্গু জ্বরে প্লেটলেট কমে যেতে পারে। তাই নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে প্লেটলেটের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
  5. ডাক্তারের পরামর্শ নিন: যদি উপসর্গ গুরুতর হয়, যেমন তীব্র পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বা রক্তক্ষরণ, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর হলে কি ঔষধ খেতে হবে

ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। সাধারণত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। নিচের ওষুধগুলো ডাক্তারের পরামর্শে নেওয়া যেতে পারে—

১. প্যারাসিটামল (Paracetamol)

  • ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান ওষুধ হলো প্যারাসিটামল (যেমন: নাপা, অ্যাডেভিল)।
  • এটি জ্বর ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
  • ডোজ: প্রাপ্তবয়স্করা ৫০০-১০০০ মিগ্রা প্রতি ৬ ঘণ্টা পরপর খেতে পারেন (দিনে সর্বোচ্চ ৪ গ্রামের বেশি নয়)।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে বয়স ও ওজন অনুযায়ী ডোজ নিতে হবে।

২. ওআরএস (ORS) বা স্যালাইন

  • ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তাই ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট (ORS) পান করা জরুরি।
  • এটি রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া রোধ করতে সাহায্য করে।

৩. তরল খাবার

  • ডাবের পানি, ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি পানিশূন্যতা দূর করে।

ডেঙ্গু জ্বর হলে কোন ঔষধ এড়িয়ে চলবেন?

ডেঙ্গু জ্বরে কিছু ওষুধ মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। নিচের ওষুধগুলো এড়িয়ে চলুন:

১. অ্যাসপিরিন (Aspirin) বা আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen)

  • এই ওষুধগুলো রক্ত পাতলা করে, ফলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে।
  • ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলে এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

২. নাপ্রোক্সেন (Naproxen) বা ডাইক্লোফেনাক (Diclofenac)

  • এই ব্যথানাশক ওষুধগুলোও রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।

ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া চিকিৎসা:

ঔষধের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে—

১. পেঁপে পাতার রস

  • পেঁপে পাতার রস প্লাটিলেট কাউন্ট বাড়াতে সাহায্য করে।
  • কয়েকটি কচি পেঁপে পাতা বেটে রস করে দিনে ২-৩ চামচ খেতে পারেন।

২. গিলয় (Giloy) বা গুড়ুচি

  • গিলয় একটি আয়ুর্বেদিক হার্ব, যা ইমিউনিটি বাড়ায়।
  • গিলয়ের ডাল বা পাতার রস গরম পানিতে ফুটিয়ে খেতে পারেন।

৩. তুলসী পাতা ও মধু

  • তুলসী পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

৪. পর্যাপ্ত পানি পান

  • দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।

কখন হাসপাতালে যাবেন?

নিচের লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালে যেতে হবে:
জ্বর ১০২°F-এর বেশি এবং ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হলে
অতিরিক্ত দুর্বলতা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
মাড়ি/নাক থেকে রক্ত পড়া
শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা
প্রস্রাব কমে গেলে
প্লাটিলেট কাউন্ট ২০,০০০-এর নিচে নেমে গেলে

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়:

ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো মেনে চলা জরুরি:

  1. মশা নিয়ন্ত্রণ: বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে দেবেন না। মশার বংশবিস্তার বন্ধ করতে প্রতিদিন জমে থাকা পানির পাত্র পরিষ্কার করুন।
  2. মশারি ব্যবহার: ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
  3. মশারোধী ক্রিম বা স্প্রে: মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারোধী ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করুন।
  4. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: বাড়ি এবং আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।

সর্বোপরি কী করবেন?

জ্বর হলে প্রথমেই প্যারাসিটামল নিন, অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ নয়।
পানিশূন্যতা রোধে ORS ও তরল খাবার খান।
প্লাটিলেট কাউন্ট নিয়মিত চেক করুন।
গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যান।

উপসংহার:

ডেঙ্গু জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা এবং সঠিক ঔষধ গ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মনে রাখবেন, নিজে সচেতন থাকুন এবং অন্যদেরও সচেতন করতে সাহায্য করুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে হাসপাতালে যান।

সুস্থ থাকুন, সতর্ক থাকুন!

এই ব্লগটি লেখার জন্য ব্যবহার করা তথ্যসূত্রগুলো হলো:

  1. World Health Organization (WHO): ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, চিকিৎসা, এবং প্রতিরোধে গাইডলাইন।
  2. Centers for Disease Control and Prevention (CDC): ডেঙ্গু সংক্রান্ত মেডিকেল পরামর্শ এবং রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কিত তথ্য।
  3. বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর: ডেঙ্গু জ্বর সংক্রান্ত দেশীয় নির্দেশিকা এবং তথ্য।
  4. মেডিকেল জার্নাল ও প্রবন্ধ: ডেঙ্গুর চিকিৎসা এবং গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত প্রবন্ধ।
Scroll to Top