
বয়স অনুযায়ী ওজন কত হওয়া উচিত?
মানুষের শরীরের ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সূচক। সঠিক ওজন বজায় রাখা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজন উভয়ই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বয়স, উচ্চতা, লিঙ্গ, এবং শারীরিক গঠন অনুযায়ী মানুষের শরীরের ওজন ভিন্ন হতে পারে। সঠিক ওজন নির্ধারণের জন্য বডি মাস ইনডেক্স (BMI) সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। তবে শিশুরা, কিশোর-কিশোরীরা, এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ওজন নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বিষয় বিবেচনা করা হয়। নিচে বয়স অনুযায়ী ওজনের আদর্শ ধারণা দেওয়া হলো:
বডি মাস ইনডেক্স (BMI) এবং ওজন নির্ধারণ:
BMI হলো ওজন এবং উচ্চতার একটি অনুপাত, যা দেখে বোঝা যায় কোনো ব্যক্তির ওজন তার উচ্চতার তুলনায় আদর্শ কিনা।
BMI গণনার পদ্ধতি:
BMI এর মান অনুযায়ী ওজনের শ্রেণিবিভাগ:
- ১৮.৫ এর কম: কম ওজন
- ১৮.৫–২৪.৯: স্বাভাবিক ওজন
- ২৫–২৯.৯: অতিরিক্ত ওজন
- ৩০ বা তার বেশি: স্থূলতা
এই মান অনুযায়ী আপনি নিজের BMI গণনা করে জানতে পারেন আপনার ওজন স্বাভাবিক কিনা।
উদাহরণ:
ধরুন, আপনার ওজন ৭০ কেজি এবং উচ্চতা ১.৭৫ মিটার (৫ ফুট ৯ ইঞ্চি)।
তাহলে আপনার বিএমআই হবে:
বিএমআই=(১.৭৫∗১.৭৫)৭০=৩.০৬২৫৭০=২২.৮৬
সুতরাং, আপনার বিএমআই হলো ২২.৮৬।
বিএমআইয়ের মান অনুযায়ী স্বাস্থ্য অবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিএমআইয়ের একটি নির্দিষ্ট মান নির্ধারণ করেছে। এই মান অনুযায়ী আপনার ওজন কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে নিচের তালিকাটি দেখুন:
বিএমআইয়ের মান | শারীরিক অবস্থা |
---|---|
১৮.৫ এর কম | ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম |
১৮.৫ – ২৪.৯ | স্বাভাবিক ওজন |
২৫.০ – ২৯.৯ | ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি |
৩০.০ – ৩৪.৯ | স্থুলতার প্রথম পর্যায় |
৩৫.০ – ৩৯.৯ | স্থুলতার দ্বিতীয় পর্যায় |
৪০.০ এর বেশি | অতিরিক্ত স্থুলতা |
এশীয়দের জন্য বিএমআই চার্ট:
বিশেষজ্ঞদের মতে, এশীয় জনগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন অনুযায়ী তাদের জন্য বিএমআইয়ের মানদণ্ড কিছুটা ভিন্ন হওয়া উচিত। নিচে এশীয়দের জন্য প্রযোজ্য বিএমআই চার্ট দেওয়া হলো:
বিএমআইয়ের মান | শারীরিক অবস্থা |
---|---|
১৮.৫ এর কম | ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম |
১৮.৫ – ২২.৯ | স্বাভাবিক ওজন |
২৩.০ – ২৪.৯ | ওজন ঝুঁকির পর্যায়ে |
২৫.০ – ২৯.৯ | স্থুলতার প্রথম পর্যায় |
৩০.০ এর বেশি | স্থুলতার দ্বিতীয় পর্যায় |
বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন (০-১২ বছর)
শিশুদের ওজন নির্ধারণে বয়স এবং উচ্চতা বিবেচনা করা হয়। জন্ম থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বৃদ্ধি দ্রুত হয়, তাই এই সময় ওজনের উপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
শিশুর আদর্শ ওজন:
- জন্মের সময়: গড়ে ২.৫-৪ কেজি।
- ৬ মাস বয়স: ওজন প্রায় দ্বিগুণ হয় (৫-৮ কেজি)।
- ১ বছর বয়স: ওজন প্রায় তিন গুণ (৮-১২ কেজি)।
- ২-৫ বছর বয়স: প্রতি বছর প্রায় ২-৩ কেজি বৃদ্ধি পায়।
- ৬-১২ বছর বয়স: প্রতি বছর গড়ে ২.৫-৩.৫ কেজি বৃদ্ধি হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ:
- ৫ বছর বয়সের শিশুর ওজন প্রায় ১৬-১৮ কেজি হওয়া উচিত।
- ১০ বছর বয়সের শিশুর ওজন প্রায় ২৬-৩০ কেজি হওয়া উচিত।
শিশুদের ওজন কম বা বেশি হলে পুষ্টিবিদের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
কিশোর-কিশোরীদের ওজন (১৩-১৯ বছর)
কিশোর বয়সে শরীরের হরমোনগত পরিবর্তন এবং বৃদ্ধি দ্রুত ঘটে। তাই এই সময়ে ওজন এবং উচ্চতা দ্রুত বাড়ে। ছেলেদের ওজন সাধারণত মেয়েদের চেয়ে বেশি হয়।
উচ্চতা এবং ওজনের গড় অনুপাত:
- ১৩-১৫ বছর:
- ছেলে: ৩৮-৫৫ কেজি
- মেয়ে: ৩৫-৫২ কেজি
- ১৬-১৮ বছর:
- ছেলে: ৫০-৬৫ কেজি
- মেয়ে: ৪৫-৬০ কেজি
এই সময়ে সুষম খাদ্য এবং নিয়মিত ব্যায়ামের প্রয়োজন।
প্রাপ্তবয়স্কদের ওজন (২০-৫০ বছর)
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ওজন নির্ধারণের ক্ষেত্রে উচ্চতা এবং বয়সকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। পুরুষ ও নারীর শারীরিক গঠন আলাদা হওয়ায় ওজনের মানও ভিন্ন হতে পারে।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজনের চার্ট (২০-৫০ বছর):
উচ্চতা (ফুট) | পুরুষের ওজন (কেজি) | নারীর ওজন (কেজি) |
৫’০” | ৫০-৫৬ | ৪৫-৫১ |
৫’২” | ৫৩-৫৮ | ৪৭-৫৫ |
৫’৪” | ৫৫-৬২ | ৫০-৬০ |
৫’৬” | ৬০-৬৭ | ৫৫-৬৫ |
৫’৮” | ৬৫-৭০ | ৫৯-৬৮ |
৬’০” | ৭০-৭৫ | ৬৩-৭৩ |
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বেশি বা কম হলে জীবনযাত্রার পরিবর্তন করা উচিত।
বয়স্কদের ওজন (৫০ বছর এবং তার বেশি)
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মেটাবলিজম কমে যায় এবং পেশির পরিবর্তে শরীরে চর্বি জমা হতে শুরু করে। তাই বয়স্কদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ওজনের পরামর্শ (৫০+ বয়স):
- পুরুষ: উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ৬০-৭০ কেজি।
- নারী: উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ৫০-৬০ কেজি।
বয়স্কদের জন্য হালকা শারীরিক ব্যায়াম এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ওজন নিয়ন্ত্রণের উপায়:
১. সুষম খাদ্য:
প্রতিদিন খাবারে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান সঠিক পরিমাণে থাকা উচিত।
২. নিয়মিত ব্যায়াম:
শরীর সুস্থ রাখার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা প্রয়োজন।
৩. পর্যাপ্ত পানি পান:
শরীরের বিপাকক্রিয়া সচল রাখতে দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
৪. ওজন নিয়মিত মাপা:
নিজের ওজন নিয়মিত মেপে তা আদর্শের মধ্যে আছে কিনা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. পর্যাপ্ত ঘুম:
ওজন নিয়ন্ত্রণে ঘুমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।
ওজন সম্পর্কিত সাধারণ ভুল ধারণা:
১. ওজন কমানো মানেই খাওয়া বন্ধ করা নয়:
সঠিক পুষ্টি না পেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
২. ওজন বেশি মানেই স্থূলতা নয়:
পেশি বেশি থাকলে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হতে পারে।
৩. উচ্চতা কম মানেই কম ওজন নয়:
উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় যদি BMI স্বাভাবিক হয়।
ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি:
১. অপুষ্টিজনিত সমস্যা
২. হাড় দুর্বল হয়ে পড়া
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
৪. থাইরয়েড সমস্যা
ওজন বেশি হওয়ার ঝুঁকি:
১. হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি
২. ডায়াবেটিস
৩. উচ্চ রক্তচাপ
৪. বাতের সমস্যা
উপসংহার:
বয়স অনুযায়ী সঠিক ওজন বজায় রাখা স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য অপরিহার্য। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলা উচিত। অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজন কোনো সমস্যার লক্ষণ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।