মাসিকের সময় কি খাবার খাওয়া উচিত
মাসিকের সময় শরীরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে মহিলাদের শরীরে বিশেষ করে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, পেটের ব্যথা, শরীর দুর্বল হওয়া, এবং কখনো কখনো মুড সুইং দেখা যায়। এই সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে মাসিকের সময়ের অসুবিধা অনেকটাই কমানো যায়।
মাসিকের সময় শরীরের পরিবর্তন কেন হয়?
মাসিকের সময়, শরীরের হরমোন যেমন ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন এর স্তর পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের কারণে অনেকের শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়:
- পেটের ব্যথা: গর্ভাশয় সঙ্কুচিত হয়ে অতিরিক্ত রক্ত বের করে।
- শরীর দুর্বল হওয়া: রক্তপাতের কারণে শরীরে আয়রনের ঘাটতি হতে পারে।
- মুড পরিবর্তন: হরমোনের ওঠানামার ফলে আবেগে পরিবর্তন ঘটে।
শরীরের এই পরিবর্তনগুলোকে সামলাতে পুষ্টিকর এবং সঠিক খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাসিকের সময় কি খাবার খাওয়া উচিত?
মাসিকের সময় শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাবার নির্বাচন করতে হবে। এমন খাবার বেছে নেওয়া উচিত যা শরীরকে শক্তি দেয়, ব্যথা কমায় এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
১. আয়রন সমৃদ্ধ খাবার:
মাসিকের সময় রক্তপাতের কারণে শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এটি থেকে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং মাথা ঘোরানোর মতো সমস্যা হতে পারে। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেলে এই ঘাটতি পূরণ করা যায়।
- পালং শাক, মেথি শাক
- লাল শাক
- কালো কিসমিস, ডুমুর
- মাংস, বিশেষ করে গরুর মাংস এবং কলিজা
২. ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার:
ক্যালসিয়াম শরীরের পেশি এবং হাড় মজবুত রাখতে সাহায্য করে। মাসিকের সময় পেশির খিঁচুনী কমানোর জন্য ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ।
- দুধ, দই, ছানা
- বাদাম, যেমন আমন্ড, আখরোট
- ছোট মাছ (যেমন ইলিশ বা কই)
৩. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার:
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং পেটের ব্যথা প্রশমিত করে। এটি মুড ভালো রাখতেও সহায়ক।
- সামুদ্রিক মাছ, যেমন স্যামন, সার্ডিন
- আখরোট, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড
৪. ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার:
ভিটামিন শরীরের বিভিন্ন কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ভিটামিন সি: লেবু, কমলা, পেয়ারা, আমলকি
- ভিটামিন ডি: ডিমের কুসুম, মাশরুম
- ভিটামিন বি৬: কলা, আলু, মিষ্টি আলু, মুরগির মাংস
৫. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার:
ফাইবার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং মাসিকের সময় পেটের গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।
- ওটস, ব্রাউন রাইস, গমের রুটি
- সবুজ শাকসবজি, যেমন ব্রকলি, বাঁধাকপি
- ফল, যেমন আপেল, নাশপাতি, বেরি
৬. পানি এবং তরল খাবার:
মাসিকের সময় শরীরে পানির পরিমাণ কমে যেতে পারে। ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং তরল খাবার খাওয়া উচিত।
- সাধারণ পানি
- নারকেলের পানি
- ফলের রস (চিনি ছাড়া)
- স্যুপ বা ঝোল
মাসিকের সময় কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?
১. অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত খাবার:
ক্যাফেইন রক্তনালীগুলো সংকুচিত করে, যা পেটের ব্যথা বাড়াতে পারে। তাই এই সময় চা বা কফি কম খাওয়া উচিত।
২. অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি:
চিনি রক্তের শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয় এবং আবার হঠাৎ কমে যায়। এর ফলে মুড সুইং বা ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
৩. প্রসেসড খাবার:
প্যাকেটজাত বা প্রসেসড খাবারে অতিরিক্ত লবণ এবং প্রিজারভেটিভ থাকে, যা শরীরে পানি ধরে রাখতে পারে এবং ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে।
৪. অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার:
লবণ শরীরে পানি জমিয়ে ফোলাভাব বাড়ায়। তাই খুব বেশি নুন দেওয়া খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
৫. ফ্যাটি এবং ভাজা খাবার:
ভাজাপোড়া এবং অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার হজমের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং শরীরকে ক্লান্ত করতে পারে।
মাসিকের সময় খাদ্যতালিকা পরিকল্পনা:
সকালের নাস্তা:
- ওটস বা কর্নফ্লেক্স
- একটি কলা বা একটি আপেল
- বাদাম ও দুধ
দুপুরের খাবার:
- ব্রাউন রাইস বা আটার রুটি
- পালং শাকের তরকারি
- মাছ বা মুরগির ঝোল
বিকেলের স্ন্যাকস:
- একমুঠো চিয়া সিড বা ফ্ল্যাক্স সিড মিশ্রিত দই
- লেবুর শরবত (চিনি ছাড়া)
রাতের খাবার:
- ডাল, সবজি, এবং ছোট মাছ
- গরম স্যুপ
বিছানায় যাওয়ার আগে:
- এক কাপ গরম দুধ (মধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে)
মাসিকের সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস কেন গুরুত্বপূর্ণ?
১. পেটের ব্যথা কমায়: পুষ্টিকর খাবার পেটের খিঁচুনী কমাতে সাহায্য করে।
২. শক্তি দেয়: শরীর দুর্বলতা কাটিয়ে শক্তি যোগায়।
৩. মুড সুইং নিয়ন্ত্রণ: সঠিক খাবার মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
৪. স্বাস্থ্য বজায় রাখা: স্বাস্থ্যকর খাদ্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৫. হরমোনের ভারসাম্য: পুষ্টিকর খাবার হরমোনের পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে।
উপসংহার:
মাসিকের সময় শরীরের চাহিদা বুঝে সঠিক খাবার নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে মাসিকের সময়ের শারীরিক কষ্ট কমানো এবং মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব। পাশাপাশি, মাসিকের সময় অস্বস্তি বা ব্যথা অত্যধিক হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই সময়ে খাবারের প্রতি যত্নশীল থাকলে মাসিকের সময়টুকু আরামদায়ক হয়ে উঠবে।