মাসিক কি

মাসিক কি এবং কেন হয়? (What is Menstruation and Why Does It Happen?)

মাসিক, যা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড নামেও পরিচিত, মেয়েদের শরীরের একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটি বয়ঃসন্ধিকালে শুরু হয় এবং মেনোপজ পর্যন্ত প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে হয়। সহজ কথায়, মাসিক হলো জরায়ুর ভেতরের আবরণ (এন্ডোমেট্রিয়াম) রক্ত এবং টিস্যুর সাথে যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে আসা।

আমাদের শরীর প্রতি মাসে গর্ভাবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়। মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে একটি ডিম্বাণু (ডিম) নির্গত হয়। যদি এই ডিম্বাণুটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত না হয় (অর্থাৎ গর্ভধারণ না হয়), তাহলে জরায়ুর ভেতরের যে পুরু আস্তরণটি গর্ভাবস্থার জন্য তৈরি হয়েছিল, তার আর প্রয়োজন হয় না। তখন এই আস্তরণটি ভেঙে রক্ত এবং টিস্যু আকারে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়াটিকেই আমরা মাসিক বলি।

এটি কোনো রোগ নয়, বরং মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সুস্থ শরীরের লক্ষণ।

মাসিক চক্র কী? (What is the Menstrual Cycle?)

মাসিক শুধু রক্তপাত নয়, এটি একটি পুরো চক্রের অংশ যাকে মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র বলে। এই চক্রটি সাধারণত একটি মাসিকের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী মাসিকের প্রথম দিন পর্যন্ত চলে। বেশিরভাগ নারীর মাসিক চক্রের সময়কাল ২৮ দিন হয়, তবে এটি ২১ থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে এবং এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

মাসিক চক্রকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:

  1. মাসিক পর্যায় (Menstrual Phase): এটি চক্রের প্রথম পর্যায়, যখন রক্তপাত হয়। এই সময় জরায়ুর আস্তরণ ঝরে যায়। সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত এটি স্থায়ী হয়।
  2. ফলিকুলার পর্যায় (Follicular Phase): মাসিকের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে ডিম্বস্ফোটনের আগ পর্যন্ত চলে। এই সময় ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু পরিপক্ক হয় এবং জরায়ুর আস্তরণ পুনরায় পুরু হতে শুরু করে, যা গর্ভাবস্থার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
  3. ডিম্বস্ফোটন পর্যায় (Ovulation Phase): এটি মাসিক চক্রের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে, সাধারণত ২৮ দিনের চক্রে ১৪তম দিনে। এই সময় ডিম্বাশয় থেকে একটি পরিপক্ক ডিম্বাণু নির্গত হয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবে চলে আসে, যা শুক্রাণুর জন্য প্রস্তুত থাকে।
  4. লুটিয়াল পর্যায় (Luteal Phase): ডিম্বস্ফোটনের পর থেকে পরবর্তী মাসিক শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই পর্যায় চলে। যদি গর্ভধারণ না হয়, তাহলে জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে যায় এবং মাসিক শুরু হয়। যদি গর্ভধারণ হয়, তাহলে এই আস্তরণটি ভ্রূণের বিকাশে সাহায্য করে।

মাসিক কখন শুরু হয় এবং কখন শেষ হয়? (When Does Menstruation Start and End?)

মাসিক শুরু হওয়ার ঘটনাকে Menarche (মেনার্কে) বলা হয়। সাধারণত এটি মেয়েদের ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয়, তবে এটি ব্যক্তিগতভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু মেয়ের মাসিক এর আগেও শুরু হতে পারে, আবার কিছু মেয়ের পরে। বয়স, জেনেটিক্স, পুষ্টি এবং শারীরিক ওজন এর উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

মাসিক শেষ হওয়ার ঘটনাকে মেনোপজ বলা হয়। এটি সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে ঘটে, যখন ডিম্বাশয় ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং মাসিক সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। মেনোপজও একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা বয়সের সাথে সাথে ঘটে।

মাসিক চলাকালীন কী কী লক্ষণ দেখা যায়? (What are the Symptoms During Menstruation?)

মাসিক চলাকালীন এবং এর আগে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলো প্রতিটি মেয়ের জন্য আলাদা হতে পারে এবং একই মেয়ের ক্ষেত্রেও মাস থেকে মাসে ভিন্ন হতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:

  • ১. পেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্প: মাসিকের সময় পেটের নিচের অংশে ব্যথা বা মোচড়ানো অনুভব হওয়া খুবই সাধারণ। একে ডিসমেনোরিয়া বলে। এই ব্যথা হালকা থেকে তীব্র হতে পারে এবং কোমর বা থাই পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। জরায়ুর সংকোচন এই ব্যথার কারণ।
  • ২. পিঠে ব্যথা: পেটের ব্যথার পাশাপাশি কোমরের নিচে বা পিঠের নিচের দিকে ব্যথা হতে পারে।
  • ৩. স্তনে ব্যথা বা স্পর্শকাতরতা: মাসিকের আগে এবং চলাকালীন স্তনে ব্যথা, ফোলা বা স্পর্শ করলে সংবেদনশীল মনে হতে পারে। এটি হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়।
  • ৪. মাথা ব্যথা: কিছু মেয়ের মাসিক চলাকালীন বা এর আগে মাথা ব্যথা বা মাইগ্রেনের সমস্যা হতে পারে।
  • ৫. ক্লান্তি ও অবসাদ: শারীরিকভাবে দুর্বল এবং ক্লান্ত অনুভব করাও একটি সাধারণ লক্ষণ।
  • ৬. মেজাজের পরিবর্তন (Mood Swings): হরমোনের তারতম্যের কারণে মন খারাপ, খিটখিটে মেজাজ, উদ্বেগ বা কান্নার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এটি প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম (PMS) এর একটি অংশ।
  • ৭. পেটে ফোলাভাব: মাসিকের সময় শরীর কিছুটা পানি ধরে রাখতে পারে, যার ফলে পেটে ফোলাভাব বা ভারি মনে হতে পারে।
  • ৮. ব্রণ: হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মাসিক শুরুর আগে বা চলাকালীন মুখে ব্রণ দেখা দিতে পারে।
  • ৯. ঘুমের সমস্যা: কিছু মেয়ে মাসিকের সময় ঘুমের সমস্যায় ভুগতে পারে।

১০. হজমের সমস্যা: কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার মতো হজমের সমস্যাও দেখা যেতে পারে।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন? (When to Consult a Doctor?)

যদিও মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন:

  • অত্যন্ত তীব্র ব্যথা: যদি পেটে ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে দৈনন্দিন কাজে বাধা দেয় এবং সাধারণ ব্যথানাশকেও না কমে।
  • অতিরিক্ত রক্তপাত: যদি প্রতি ঘণ্টায় বা দুই ঘণ্টায় প্যাড বা ট্যাম্পন পরিবর্তন করতে হয়, বা রক্তে বড় জমাট বাধা (blood clots) দেখা যায়।
  • অনিয়মিত মাসিক: যদি আপনার মাসিক চক্র হঠাৎ করে অনিয়মিত হয়ে যায়, বা মাসিক অনেক দিন পর পর হয়।
  • মাসিকের মাঝখানে রক্তপাত: যদি দুই মাসিকের মাঝখানে রক্তপাত হয়।
  • মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া: যদি আপনার মাসিক তিন মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে, যখন আপনি গর্ভবতীও নন।
  • ৪০ বছর বয়সের আগে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া: এটি সময়ের আগে মেনোপজের লক্ষণ হতে পারে।
  • মাসিকের লক্ষণগুলি হঠাৎ পরিবর্তিত হওয়া: যদি আপনার মাসিক পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক বা অস্বাভাবিক মনে হয়।

মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি (Hygiene and Sanitation During Menstruation)

মাসিকের সময় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সংক্রমণ এবং অস্বস্তি প্রতিরোধে সাহায্য করে।

  • ১. প্যাড/ট্যাম্পন নিয়মিত পরিবর্তন: ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ নিয়মিত পরিবর্তন করা উচিত। প্যাড ৪-৬ ঘণ্টা এবং ট্যাম্পন সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা পর পর পরিবর্তন করা উচিত। মেনস্ট্রুয়াল কাপ নির্দেশিকা অনুযায়ী পরিষ্কার ও ব্যবহার করতে হবে।
  • ২. নিজেকে পরিষ্কার রাখা: প্রতিবার প্যাড পরিবর্তনের সময় উষ্ণ পানি দিয়ে যোনি এলাকা পরিষ্কার করা উচিত। সামনে থেকে পিছনের দিকে পরিষ্কার করবেন, যাতে মলদ্বার থেকে জীবাণু যোনিতে প্রবেশ করতে না পারে। সুগন্ধিযুক্ত সাবান বা পণ্য ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এতে সংবেদনশীল ত্বকে জ্বালা হতে পারে।
  • ৩. সঠিক অন্তর্বাস: পরিষ্কার এবং আরামদায়ক সুতির অন্তর্বাস পরা উচিত। সুতি বাতাস চলাচল করতে সাহায্য করে এবং আর্দ্রতা কমায়, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে।

৪. ব্যবহৃত প্যাডের সঠিক নিষ্পত্তি: ব্যবহৃত প্যাড বা ট্যাম্পনগুলো টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে নির্দিষ্ট বর্জ্য ফেলার স্থানে ফেলুন, কমোডে ফ্লাশ করবেন না।

মাসিক নিয়ে ভুল ধারণা (Myths about Menstruation)

আমাদের সমাজে মাসিক নিয়ে অনেক ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এগুলো দূর করা এবং সঠিক তথ্য জানা খুবই জরুরি:

  • মাসিক ‘অপবিত্র’ নয়: এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। এটিকে অপবিত্র বা লজ্জাজনক মনে করা ঠিক নয়।
  • মাসিক চলাকালীন গোসল করা উচিত: মাসিক চলাকালীন গোসল করা খুবই জরুরি। এটি পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং আরামদায়ক অনুভূতি দেয়।
  • মাসিক চলাকালীন সবকিছু খাওয়া যায়: পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত এবং বিশেষ কোনো খাবার এড়িয়ে চলার প্রয়োজন নেই, যদি না কোনো নির্দিষ্ট খাবার আপনার অস্বস্তি বাড়ায়।
  • শারীরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার প্রয়োজন নেই: মাসিক চলাকালীন হালকা ব্যায়াম বা স্বাভাবিক শারীরিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এটি অনেক সময় মাসিকের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে।

উপসংহার:

মাসিক মেয়েদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শারীরিক পরিপক্কতা এবং প্রজনন ক্ষমতার একটি চিহ্ন। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মেয়ে এবং তার পরিবারের জন্য খুবই জরুরি। এটি শুধুমাত্র শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও সাহায্য করে।

যদি আপনার মাসিক সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন থাকে বা কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে লজ্জা না পেয়ে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।

মাসিক কি সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্যের জন্য:

Scroll to Top