মাসিক কি

মাসিক কি ?

মাসিক বা ঋতুস্রাব একটি প্রাকৃতিক শারীরিক প্রক্রিয়া, যা নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও শারীরিক স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত প্রজননক্ষম নারীদের শরীরে একটি মাসিক চক্রের অংশ, যেখানে জরায়ুর লাইনিং নির্দিষ্ট সময়ে ভেঙে রক্তক্ষরণ আকারে বের হয়ে আসে। এই প্রক্রিয়া সাধারণত প্রতি ২৮ দিন পরপর ঘটে, যদিও এটি ব্যক্তিভেদে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। নিচে বিস্তারিত জেনে নেই মাসিক কি |

মাসিক কি এবং কেন এটি ঘটে ?

মাসিক একটি নারীর শরীরে ঘটে যাওয়া হরমোনজনিত প্রক্রিয়া। নারীদের প্রজনন অঙ্গ, বিশেষ করে জরায়ু, ডিম্বাশয়, এবং ভ্যাজাইনা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। মাসিকের মূল উদ্দেশ্য হলো নারীর প্রজনন সিস্টেমকে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করা।

প্রতিমাসে ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম্বাণু মুক্ত হয়, যা ডিম্বস্ফুটন (Ovulation) নামে পরিচিত। ডিম্বাণুটি নিষিক্ত না হলে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আবরণটি ভেঙে যায় এবং এটি রক্ত ও টিস্যুর আকারে শরীর থেকে বের হয়ে আসে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই মাসিক নামে পরিচিত।

মাসিক কিভাবে হয়?

মাসিক চক্র (Menstrual Cycle) হলো নারীদেহের হরমোন নিয়ন্ত্রিত একটি প্রক্রিয়া, যা গড়ে ২৮ দিনে সম্পন্ন হয় (২১-৩৫ দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক)। এই চক্রের প্রধান পর্যায়গুলো হলো:

১. মাসিক বা রক্তস্রাব (Menstrual Phase – দিন ১-৫)

  • জরায়ুর ভেতরের স্তর (এন্ডোমেট্রিয়াম) ভেঙে রক্ত ও টিস্যু যোনিপথে বের হয়।
  • সাধারণত ৩-৭ দিন পর্যন্ত রক্তস্রাব হয়।
  • এই সময় পেটে ব্যথা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি বা মুড সুইং হতে পারে।

২. ফলিকুলার ফেজ (Follicular Phase – দিন ৬-১৪)

  • এই সময় ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু (Egg) তৈরি হয়।
  • জরায়ুর আস্তরণ আবার পুরু হতে শুরু করে।

৩. ডিম্বস্ফোটন (Ovulation – দিন ১৪-১৬)

  • ডিম্বাশয় থেকে একটি পরিপক্ব ডিম্বাণু নির্গত হয়।
  • এই সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

৪. লিউটিয়াল ফেজ (Luteal Phase – দিন ১৭-২৮)

  • যদি ডিম্বাণু নিষিক্ত না হয়, তাহলে জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে মাসিক শুরু হয়।

মাসিক কখন শুরু হয়?

  • সাধারণত ১১-১৫ বছর বয়সে প্রথম মাসিক (Menarche) হয়।
  • বংশগতি, পুষ্টি ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে মাসিক শুরুর সময় পরিবর্তিত হয়।
  • ১৬ বছর বয়সের পরেও যদি মাসিক না হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মাসিকের লক্ষণ:

মাসিকের আগে ও সময়ে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:
শারীরিক লক্ষণ:

  • তলপেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্প
  • স্তনে ব্যথা বা ভারীভাব
  • মাথাব্যথা, কোমর ব্যথা
  • বমি বমি ভাব বা ডায়রিয়া

মানসিক লক্ষণ:

  • মুড সুইং (মেজাজের পরিবর্তন)
  • খিটখিটে ভাব বা দুশ্চিন্তা
  • ক্লান্তি বা ঘুমের সমস্যা
  • মনোযোগের অভাব

এই লক্ষণগুলো PMS (Premenstrual Syndrome) নামে পরিচিত।

মাসিকের সময় কী করবেন?

১. স্যানিটারি প্যাড/ট্যাম্পন/মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার

  • স্যানিটারি প্যাড: সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ উপায়। প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা পর পরিবর্তন করুন।
  • ট্যাম্পন: ভেজাইনা দিয়ে ঢুকিয়ে ব্যবহার করা হয়। ৮ ঘণ্টার বেশি রাখা উচিত নয়।
  • মেনস্ট্রুয়াল কাপ: সিলিকন দিয়ে তৈরি, যা রক্ত সংগ্রহ করে। এটি পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘস্থায়ী।

২. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন

  • প্রতি বার টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন।
  • প্যাড বা কাপ নিয়মিত পরিবর্তন করুন।
  • সুতির অন্তর্বাস ব্যবহার করুন এবং পরিষ্কার রাখুন।

৩. স্বাস্থ্যকর খাবার খান

  • আয়রন সমৃদ্ধ খাবার: পালং শাক, ডাল, লাল মাংস (রক্তশূন্যতা রোধে)।
  • ক্যালসিয়াম: দুধ, দই, পনির (হাড় মজবুত রাখে)।
  • পানি বেশি পান করুন (ডিহাইড্রেশন রোধে)।

৪. ব্যায়াম ও বিশ্রাম

  • হালকা ব্যায়াম (হাঁটা, যোগব্যায়াম) মাসিকের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন।

মাসিকের ব্যথা কমানোর উপায়:

  • গরম সেঁক: তলপেটে গরম পানির বোতল বা হিটিং প্যাড দিলে ব্যথা কমে।
  • হালকা ম্যাসাজ: তেল দিয়ে পেট ম্যাসাজ করুন।
  • ওষুধ: প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রফেন খেতে পারেন (ডাক্তারের পরামর্শে)।
  • প্রাকৃতিক উপায়: আদা চা, গরম পানিতে লেবু-মধু খাওয়া উপকারী।

মাসিকের সময় শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন:

মাসিকের সময় নারীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। এগুলোকে সাধারণত প্রাক-মাসিক বা PMS (Premenstrual Syndrome) এবং মাসিক চলাকালীন লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মাসিক সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা:

কিছু নারী মাসিকের সময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এসব সমস্যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে।

  1. ডিসমেনোরিয়া (Dysmenorrhea):
    মাসিকের সময় অতিরিক্ত পেটব্যথা বা ক্র্যাম্প।
  2. অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ:
    খুব বেশি বা খুব কম রক্তক্ষরণ।
  3. পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS):
    অনিয়মিত মাসিক এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
  4. এনডোমেট্রিওসিস (Endometriosis):
    জরায়ুর বাইরের টিস্যু বৃদ্ধিজনিত ব্যথা।
  5. অ্যামেনোরিয়া (Amenorrhea):
    মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া।

মাসিক নিয়ে ভুল ধারণা:

মাসিকের সময় গোসল করা যাবে না।
✅ সত্য: গোসল করা নিরাপদ, বরং পরিষ্কার থাকা জরুরি।

মাসিকের সময় পুজো বা রান্না করা নিষেধ।
✅ সত্য: মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এতে ধর্মীয় বা সামাজিক বাধা নেই।

মাসিকের রক্ত নোংরা।
✅ সত্য: এটি শরীরের স্বাভাবিক রক্ত ও টিস্যু, যা কোনো ক্ষতি করে না।

মাসিক নিয়ে সামাজিক ট্যাবু ও সচেতনতা:

আজও সমাজের কিছু অংশে মাসিক নিয়ে অনেক কুসংস্কার ও ট্যাবু রয়েছে। নারীদের মাসিক নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করা হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

সচেতনতা বৃদ্ধি:

  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা।
  • পরিবারের মধ্যে মাসিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলা।
  • স্যানিটারি পণ্য সহজলভ্য করা।

মাসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা:

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাসিক স্বাস্থ্য সেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  1. স্বাস্থ্যকর স্যানিটারি পণ্য:
    স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন, বা মেন্সট্রুয়াল কাপের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।
  2. ডাক্তারি পরামর্শ:
    মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা বা অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  3. পর্যাপ্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:
    স্কুলে স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে কিশোরীদের মাসিক নিয়ে সচেতন করা।

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

নিচের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন:

  • অতিরিক্ত রক্তপাত (১-২ ঘণ্টায় প্যাড ভিজে গেলে)।
  • ৭ দিনের বেশি মাসিক চললে
  • অস্বাভাবিক ব্যথা যা সাধারণ কাজে বাধা দেয়।
  • মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে (গর্ভাবস্থা ছাড়া)।
  • অনিয়মিত মাসিক (৩ মাস বা বেশি বন্ধ থাকলে)।

মাসিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন:

মাসিক লুকানোর কিছু নয়। পরিবার ও স্কুলে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত, যাতে কিশোরীরা লজ্জা বা ভয় না পায়।

উপসংহার:

মাসিক একটি প্রাকৃতিক শারীরিক প্রক্রিয়া, যা নারীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই প্রক্রিয়াকে বোঝা এবং এর যত্ন নেওয়া জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাসিকের সময় নারীদের সুস্থতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। মাসিক নিয়ে কোনো লজ্জা বা সংকোচ না রেখে এটি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত, যাতে সমাজে এর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবার ধারণা স্পষ্ট হয়।

সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন!

মাসিক কি সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্যের জন্য:

Scroll to Top