মেয়েদের সাদা স্রাব

মেয়েদের সাদা স্রাব কি ও কেন হয় ?

সাদা স্রাব বা ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ হল নারীদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটি জরায়ু, সার্ভিক্স (গর্ভাশয়ের মুখ) এবং যোনির গ্রন্থি থেকে নির্গত একটি তরল যা যোনি পরিষ্কার ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। অনেক নারী এই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বাভাবিক এবং শারীরিক সুস্থতার একটি চিহ্ন। চলুন বিস্তারিত জেনে নিই, মেয়েদের সাদা স্রাব কেন হয়, কখন এটি স্বাভাবিক এবং কখন এটি সমস্যা হতে পারে।

সাদা স্রাব কী?

সাদা স্রাব হল একধরনের তরল যা যোনি থেকে বের হয়। এটি সাধারণত সাদা বা স্বচ্ছ রঙের হয় এবং এতে তেমন কোনো গন্ধ থাকে না। এটি যোনির স্বাভাবিক আর্দ্রতা বজায় রাখে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং শুক্রাণুর চলাচল সহজ করে গর্ভধারণে সহায়তা করতে পারে।

সাদা স্রাবের কারণসমূহ:

নারীদের সাদা স্রাব বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে কিছু স্বাভাবিক এবং কিছু অস্বাভাবিক। চলুন কিছু সাধারণ কারণ সম্পর্কে জানি:

১. হরমোনের পরিবর্তন

মেয়েদের শরীরে হরমোনের ওঠানামা হলে সাদা স্রাবের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। বিশেষ করে মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে, গর্ভাবস্থায়, ডিম্বস্ফোটন (ovulation) সময় এবং রজঃনিবৃত্তির (menopause) আগে-পরে এর পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।

২. যৌন উত্তেজনা

যৌন উত্তেজনার সময় যোনি থেকে স্বচ্ছ বা সাদা স্রাব নির্গত হতে পারে, যা যোনিকে প্রাকৃতিকভাবে তৈলাক্ত করতে সাহায্য করে। এটি একেবারেই স্বাভাবিক।

৩. গর্ভাবস্থা

গর্ভধারণের সময় নারীদের শরীরে প্রোজেস্টেরন (progesterone) হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে সাদা স্রাবের পরিমাণ বেশি হতে পারে। এটি গর্ভের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

৪. জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা হরমোনাল ওষুধ

যেসব নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা অন্য কোনো হরমোনাল ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্য পরিবর্তিত হওয়ার কারণে সাদা স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

৫. সংক্রমণ বা ইনফেকশন

কখনো কখনো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে সাদা স্রাব অস্বাভাবিক হয়ে যায়। যেমন:

  • ইস্ট ইনফেকশন (Candida বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণ): এতে ঘন, দইয়ের মতো সাদা স্রাব হয় এবং চুলকানি হতে পারে।
  • ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস (BV): এতে ধূসর বা সাদা স্রাব হতে পারে, সাথে দুর্গন্ধ থাকতে পারে।
  • ট্রাইকোমোনিয়াসিস: এটি একটি যৌনবাহিত রোগ (STD), যাতে সাদা, হলুদ বা সবুজ রঙের স্রাব হতে পারে।

সাদা স্রাব কখন চিন্তার বিষয়?

যদি সাদা স্রাবের সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো থাকে, তবে এটি কোনো সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে:

  • দুর্গন্ধযুক্ত বা মাছের মতো গন্ধ
  • দইয়ের মতো ঘন বা অতিরিক্ত পাতলা স্রাব
  • স্রাবের রঙ পরিবর্তন (হলুদ, সবুজ বা ধূসর হয়ে যাওয়া)
  • চুলকানি, জ্বালাপোড়া বা ব্যথা
  • প্রস্রাব করার সময় জ্বালা বা ব্যথা যদি এই লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা যায়, তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সাদা স্রাব প্রতিরোধ ও প্রতিকার:

সাদা স্রাব যদি স্বাভাবিক হয়, তবে এটি প্রতিরোধ করার কোনো দরকার নেই। তবে যদি এটি সংক্রমণের কারণে হয়, তাহলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা

  • প্রতিদিন যোনি পরিষ্কার করুন স্বাভাবিক পানি দিয়ে।
  • সুগন্ধিযুক্ত সাবান, স্প্রে বা ওয়াইপ ব্যবহার করবেন না, কারণ এগুলো যোনির স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
  • প্রস্রাবের পর সামনের দিক থেকে পিছনের দিকে মুছুন, যাতে মলদ্বারের জীবাণু যোনিতে প্রবেশ করতে না পারে।

২. স্বাস্থ্যকর অন্তর্বাস পরা

  • তুলার তৈরি অন্তর্বাস ব্যবহার করুন, যা বাতাস চলাচলে সাহায্য করে।
  • খুব টাইট প্যান্ট বা সিন্থেটিক অন্তর্বাস পরা থেকে বিরত থাকুন।

৩. পর্যাপ্ত পানি পান করা

  • শরীরের অভ্যন্তরীণ সুস্থতা বজায় রাখতে এবং টক্সিন দূর করতে প্রচুর পানি পান করুন।

৪. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা

  • বেশি পরিমাণে দই, ফলমূল ও সবজি খান।
  • খুব বেশি চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো ইস্ট ইনফেকশনের প্রবণতা বাড়াতে পারে।

৫. নিরাপদ যৌন অভ্যাস

  • যৌন সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কনডম ব্যবহার করুন।
  • একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে, তাই সতর্ক থাকুন।

চিকিৎসকের পরামর্শ কখন নেওয়া উচিত?

যদি আপনার সাদা স্রাব স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, দুর্গন্ধযুক্ত হয়, চুলকানি বা জ্বালাপোড়া থাকে, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান। বিশেষ করে যদি এটি যৌনবাহিত রোগের লক্ষণ হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।

উপসংহার:

সাদা স্রাব নারীদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অংশ। এটি সাধারণত ক্ষতিকর নয়, তবে যদি এর ধরন পরিবর্তিত হয় বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে সতর্ক হওয়া উচিত। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে যোনির সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব। আপনার যদি কোনো উদ্বেগ থাকে, তাহলে দেরি না করে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

আশা করি এই ব্লগটি আপনাকে সাহায্য করবে এবং আপনার উদ্বেগ দূর করবে!

Scroll to Top