সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে না

সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে না?

অনেক দম্পতির মনে একটি সাধারণ প্রশ্ন থাকে — সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে না? কেউ কেউ আবার জানতে চান, “সহবাসের পর কতদিন পর্যন্ত গর্ভধারণের ঝুঁকি থাকে?”
এই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে — গর্ভধারণ কীভাবে ঘটে, এবং নারীর মাসিক চক্র ও ডিম্বস্ফোটনের সময় কীভাবে কাজ করে।

গর্ভধারণ কিভাবে ঘটে?

গর্ভধারণ একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। নারীদের মাসিক চক্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপে সম্পন্ন হয়:

  1. ডিম্বস্ফোটন (Ovulation):
    • একজন নারীর ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে একটি পরিপক্ক ডিম্বাণু নির্গত হয়।
    • সাধারণত মাসিক চক্রের ১৪তম দিনে এটি ঘটে, তবে এটি ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হতে পারে।
  2. নিষেক (Fertilization):
    • যদি সহবাসের সময় পুরুষের শুক্রাণু নারীর জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে এবং একটি ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয়, তবে নিষেক ঘটে।
    • শুক্রাণু সাধারণত ৩-৫ দিন পর্যন্ত নারীর শরীরে বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু ডিম্বাণু মাত্র ১২-২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকে।
  3. ভ্রূণ রোপণ (Implantation):
    • নিষেকের পরে নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুর দেওয়ালে সংযুক্ত হয়, যা সাধারণত ৬-১২ দিনের মধ্যে ঘটে।
    • এই সময়ে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে কিছু নারীর সামান্য রক্তপাত (ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং) হতে পারে।

নারীর মাসিক চক্র ও ডিম্বস্ফোটনের সময়:

সাধারণত নারীর মাসিক চক্র ২৮ দিন হয় (কিছু ক্ষেত্রে ২৬–৩২ দিন পর্যন্ত হতে পারে)।
ডিম্বস্ফোটন সাধারণত মাসিক শুরুর ১৪ দিন আগে ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ:

  • যদি কারো মাসিকের সময়কাল ২৮ দিন হয়, তাহলে ১৪তম দিনে ডিম্বস্ফোটন হয়।

  • যদি মাসিক ৩০ দিনে হয়, তাহলে ১৬তম দিনে ডিম্বস্ফোটন হয়।

ডিম্বস্ফোটনের আগে ও পরে ২–৩ দিনকে “ফার্টাইল উইন্ডো” বা গর্ভধারণের সম্ভাবনাময় সময় বলা হয়।
এই সময় সহবাস করলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।

সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে না?

সহবাসের দিন ও সময়ের ওপর ভিত্তি করে গর্ভধারণের সম্ভাবনা নির্ভর করে।
সাধারণভাবে বলা যায় —

সময়

গর্ভধারণের সম্ভাবনা

মাসিকের ১ম–৭ম দিন

খুব কম

৮ম–১১তম দিন

মাঝারি

১২–১৬তম দিন (ডিম্বস্ফোটন সময়)

সবচেয়ে বেশি

১৭–২১তম দিন

মাঝারি

২২–২৮তম দিন

কম বা প্রায় নেই

অর্থাৎ, ডিম্বস্ফোটন সময়ের বাইরে সহবাস করলে সাধারণত গর্ভধারণ হয় না।
তবে প্রতিটি নারীর শরীর আলাদা, তাই শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

সহবাসের পর কতদিনে বাচ্চা পেটে আসে?

  • ডিম্বস্ফোটন সময়ে সহবাস করলে, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের পর প্রায় ৫–৬ দিন পর নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেয়ালে (uterine wall) স্থাপন হয়।
    এই অবস্থায় গর্ভধারণ শুরু হয়।
  • সাধারণত সহবাসের ১০-১৪ দিনের মধ্যে গর্ভধারণ হলে সেটি টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়।
  • কিছু ক্ষেত্রে, গর্ভধারণের লক্ষণ যেমন বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, স্তনের সংবেদনশীলতা ইত্যাদি ২-৩ সপ্তাহ পর দেখা যেতে পারে।
  • গর্ভধারণ নিশ্চিত করার জন্য গর্ভধারণ পরীক্ষা (Pregnancy Test) করা যেতে পারে, যা প্রস্রাবের মাধ্যমে করা হয় এবং হরমোন HCG নির্ণয় করে।
  • আরও নিশ্চিত হতে চাইলে আল্ট্রাসাউন্ড করানো যেতে পারে।

কখন সহবাস করলে বাচ্চা পেটে আসে না?

নিম্নলিখিত সময়গুলোতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুব কম বা নেই বললেই চলে—

  1. মাসিক শুরুর প্রথম ৭ দিন:
    এই সময়ে ডিম্বস্ফোটন ঘটে না। তাই গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুবই কম।

  2. মাসিকের শেষ সপ্তাহ (২২–২৮ দিন):
    এই সময় ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যায়, ফলে নিষেক সম্ভব হয় না।

  3. নিরাপদ দিন গণনা (Safe Period Method):
    যদি মাসিক নিয়মিত হয়, তাহলে ১ম–৭ম দিন এবং ২১–২৮ দিন নিরাপদ দিন হিসেবে ধরা যেতে পারে।

তবে মনে রাখতে হবে— এই পদ্ধতি শতভাগ নিরাপদ নয়, কারণ অনেক সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ডিম্বস্ফোটন সময় পরিবর্তন হতে পারে।

গর্ভধারণ না হওয়ার কারণসমূহ:

অনেক সময় সহবাসের সঠিক সময়ে হলেও গর্ভধারণ হয় না। এর পেছনে থাকতে পারে নিম্নলিখিত কারণগুলোঃ

  1. ডিম্বাণু তৈরি না হওয়া (Anovulation)

  2. শুক্রাণুর সংখ্যা বা গুণগত মান কম থাকা (Low sperm count)

  3. হরমোনের ভারসাম্যহীনতা

  4. বয়স বেশি হওয়া (৩৫ এর বেশি হলে)

  5. অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ

  6. স্থূলতা (Obesity)

  7. থাইরয়েড সমস্যা বা পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)

এ কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রজনন পরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যা শনাক্ত করা প্রয়োজন।

গর্ভধারণে সহায়ক খাবার:

যারা গর্ভধারণে আগ্রহী, তাদের জন্য নিম্নলিখিত খাবারগুলো উপকারী হতে পারে—

  • ডিম ও মাছ (ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ)

  • শাকসবজি ও ফলমূল (ফলেট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ)

  • বাদাম ও বীজ (ভালো চর্বি সরবরাহ করে)

  • দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার

  • লিন প্রোটিন (চিকেন, ডাল, সয়াবিন ইত্যাদি)

অন্যদিকে, যারা গর্ভধারণ এড়াতে চান, তারা ডিম্বস্ফোটন সময়ের সহবাস এড়িয়ে চলবেন এবং প্রয়োজনে গর্ভনিরোধক ব্যবহার করবেন।

গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ানোর উপায়:

  • নিয়মিত স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • সঠিক সময়ে সহবাস করুন, বিশেষ করে ডিম্বস্ফোটনের সময়।
  • স্ট্রেস কমান এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
  • প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

গর্ভধারণ প্রতিরোধের উপায়:

যারা সন্তান নিতে চান না, তাদের জন্য কিছু নিরাপদ উপায় রয়েছে—

  1. কনডম ব্যবহার (Male/Female Condom)

  2. ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল (জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি)

  3. কপার টি (IUCD)

  4. ইনজেকশন বা ইমপ্লান্ট পদ্ধতি

  5. নিরাপদ দিন গণনা (Safe Period Method)

এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কনডম সবচেয়ে নিরাপদ, কারণ এটি শুধু গর্ভধারণ নয়, যৌনবাহিত রোগ থেকেও রক্ষা করে।

সহবাসের কত দিন পর গর্ভধারণ বোঝা যায়?

সাধারণত সহবাসের ১০–১৪ দিন পর গর্ভধারণ বোঝা যায়।
প্রাথমিক কিছু লক্ষণ হতে পারে—

  • বমি বমি ভাব বা বমি

  • স্তনে ব্যথা বা ভারী লাগা

  • হালকা রক্তপাত (implantation bleeding)

  • অতিরিক্ত ক্লান্তি

  • মাসিক না আসা

এই সময়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট (urine HCG test) ব্যবহার করে পরীক্ষা করা যায়।

সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে না –

  • মাসিকের প্রথম ৭ দিন ও শেষ ৭ দিন গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুব কম।

  • ডিম্বস্ফোটন সময় (১২–১৬ দিন) সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

  • নিরাপদ থাকতে চাইলে কনডম বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করা উচিত।

  • গর্ভধারণ একেকজন নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে, তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নেয়া উচিত।

চিকিৎসকের পরামর্শ কখন নেবেন?

  • সহবাসের পর বাচ্চা পেটে আসবে কি না তা নির্ভর করে অনেক জৈবিক ও হরমোনজনিত বিষয়ের ওপর।
  • অনিয়মিত মাসিক, PCOS, বা থাইরয়েড সমস্যা থাকলে ডিম্বস্ফোটন প্রভাবিত হতে পারে।
  •  সন্তান নিতে চাইলে বা না চাইলে সবসময় একজন গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নিন।
  • ১২ মাসের বেশি সময় ধরে চেষ্টা করার পরও যদি গর্ভধারণ না হয়।
  • মাসিক চক্র অনিয়মিত হলে।
  • অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি বা হরমোনজনিত সমস্যা থাকলে।
  • আগের গর্ভধারণে জটিলতা থাকলে।

উপসংহার:

সহবাসের কত দিন পর বাচ্চা পেটে আসে না — এটি নির্ভর করে নারীর মাসিক চক্র, ডিম্বস্ফোটন সময়, এবং শুক্রাণু-ডিম্বাণুর জীবদ্দশার ওপর।
সঠিক সময় জেনে, সচেতনভাবে জীবনযাপন করলে গর্ভধারণ পরিকল্পনা করা বা প্রতিরোধ করা — দুটোই সম্ভব।

👉 মনে রাখবেন, এই তথ্যগুলো সাধারণ শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। আপনার শরীরের অবস্থা, হরমোন, ও স্বাস্থ্য অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পরামর্শের জন্য অবশ্যই ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

Scroll to Top