
সিস্ট কি? কারণ, লক্ষণ, ঝুঁকি ও চিকিৎসা
আমাদের শরীর একটি জটিল গঠন নিয়ে কাজ করে। শরীরের ভেতরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছে। তবে মাঝে মাঝে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন হতে পারে। এর মধ্যেই একটি সাধারণ সমস্যা হলো সিস্ট (Cyst)। অনেকেই সিস্টকে টিউমার বা ক্যানসারের সাথে গুলিয়ে ফেলেন, কিন্তু আসলে সিস্ট সবসময় ভয়ঙ্কর নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিস্ট ক্ষতিকর নয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা সিস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা আপনাকে একটি প্রাথমিক ধারণা দেবে এবং অপ্রয়োজনীয় ভয় কমাতে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন, এই তথ্য কেবল সাধারণ জ্ঞানের জন্য, কোনো গুরুতর সমস্যায় অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
সিস্ট কি?
সহজ ভাষায়, সিস্ট হলো একটি থলির মতো গঠন, যার ভিতরে তরল, গ্যাস, অর্ধ-কঠিন পদার্থ, বা অন্য কোনো পদার্থ জমা হতে পারে। এটি শরীরের প্রায় যেকোনো অংশে বা অঙ্গে তৈরি হতে পারে, যেমন ত্বক, ডিম্বাশয়, কিডনি, বা স্তন। সিস্টের আকার ভিন্ন হতে পারে – কিছু সিস্ট এতটাই ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না, আবার কিছু সিস্ট অনেক বড় হতে পারে।
সিস্ট সাধারণত ক্যান্সারযুক্ত নয় (benign), অর্থাৎ এটি ক্ষতিকর নয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে, কিছু বিরল ক্ষেত্রে সিস্ট ক্যান্সারযুক্ত হতে পারে, তাই যেকোনো অস্বাভাবিক ফোলা বা সিস্ট দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
সিস্টের প্রকারভেদ:
- স্কিন সিস্ট (Skin Cyst): ত্বকের নিচে তৈরি হওয়া সিস্টকে সাধারণত এপিডারমাল সিস্ট (Sebaceous Cyst) বলা হয়। এটি ত্বকের নিচে একটি ছোট গোলাকার থলি তৈরি করে, যাতে সেবাম (এক ধরনের তেল) অথবা মৃত ত্বকের কোষ থাকে। এটি সাধারণত ব্যথাহীন থাকে, তবে যদি সিস্টে ইনফেকশন ঘটে, তবে এটি ফুলে উঠতে পারে এবং ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত এটি নিরীহ এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সহজেই অপসারণ করা যায়।
- ওভারিয়ান সিস্ট (Ovarian Cyst): মহিলাদের ডিম্বাশয়ে (ovary) তৈরি হওয়া সিস্টকে ওভারিয়ান সিস্ট বলা হয়। এটি সাধারণত মাসিক চক্রের অংশ হিসেবে তৈরি হতে পারে এবং অধিকাংশ সময় এটি নিরীহ থাকে। তবে কখনো কখনো এটি বড় হয়ে গিয়ে পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। কিছু সিস্ট হরমোনের প্রভাবের কারণে সৃষ্টি হতে পারে, যেমন ফোলিকুলার সিস্ট বা কোরপাস লুটিয়াম সিস্ট, যা মাসিক চক্রের সময় তৈরি হয় এবং সাধারণত কিছু মাসের মধ্যে চলে যায়।
- ব্রেস্ট সিস্ট (Breast Cyst): স্তনের মধ্যে তরলভর্তি সিস্ট তৈরি হতে পারে। এই সিস্টটি সাধারণত তরল পদার্থ ধারণ করে এবং এটি স্তনের ত্বক বা টিস্যুর নিচে একটি গোলাকার ব্যাগের মতো অনুভূত হয়। এর আকার পরিবর্তন করতে পারে এবং এটি ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় এটি নিরীহ থাকে, তবে কখনো কখনো স্তন ক্যান্সারের সাথে বিভ্রান্ত হতে পারে, তাই চিকিৎসককে পরামর্শ নেয়া উচিত।
- কিডনি সিস্ট (Kidney Cyst): কিডনির মধ্যে সিস্ট তৈরি হলে এটি প্যাকার্ট সিস্ট নামে পরিচিত। এই সিস্টগুলি সাধারণত কোনো উপসর্গ সৃষ্টি করে না এবং এটি কিডনির কার্যকারিতা প্রভাবিত করে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি বড় হয়ে গিয়ে কিডনির কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি সিস্টটি দুইটি বা ত্রৈমাসিক আকারে বৃদ্ধি পায়।
- ডার্মোইড সিস্ট (Dermoid Cyst): এটি একটি বিশেষ ধরনের সিস্ট যা শরীরের এক বা একাধিক টিস্যু ধারণ করে, যেমন চুল, দাঁত, ত্বক বা অন্যান্য অংশ। এই সিস্ট সাধারণত ডিম্বাশয়ে দেখা যায়, কিন্তু এটি শরীরের অন্য অংশেও তৈরি হতে পারে। এটি সাধারণত বেনাইন (non-cancerous) থাকে, তবে যদি এটি খুব বড় হয়ে যায়, তবে এটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন করতে পারে।
- চামড়া ও হাড়ের সিস্ট (Bone Cyst): হাড়ের মধ্যে সিস্ট তৈরি হলে এটি একটি ফাঁপা অংশের মতো হয় এবং সিস্টের আকার বা স্থানে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এটি বিশেষত ছোটদের মধ্যে দেখা যায় এবং যখন এটি বড় হয়, তখন হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর চিকিৎসা সাধারণত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে করা হয়।
সিস্টের কারণ:
সিস্টের সৃষ্টি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে বেশ কিছু সাধারণ কারণ হলো:
- হারমোনাল পরিবর্তন:
মাসিক চক্রের সময় অথবা গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে সিস্ট সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে মহিলা রোগীদের মধ্যে মাসিক চক্রের সময় বা গর্ভাবস্থায় এর সৃষ্টি হতে পারে। - ইনফেকশন বা সংক্রমণ:
শরীরের বিভিন্ন অংশে ইনফেকশন হলে, যেমন ত্বক বা গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের ইনফেকশনের কারণে সিস্ট তৈরি হতে পারে। - ব্লকেজ বা অবরোধ:
কোনো গ্রন্থি বা টিউব ব্লক হয়ে গেলে বা কোনো অঙ্গের সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে সিস্ট তৈরি হতে পারে। - জেনেটিক বা বংশগত কারণ:
অনেক সিস্ট বংশগতভাবে হতে পারে এবং পারিবারিক ইতিহাসে এটি বেশি দেখা যেতে পারে। যেমন, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) মহিলাদের মধ্যে সিস্টের সৃষ্টি করতে পারে। - স্ট্রেস ও জীবনযাত্রা:
অতিরিক্ত শারীরিক বা মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, এবং অনিয়মিত জীবনযাত্রা সিস্টের সৃষ্টি করতে পারে।
সিস্টের লক্ষণ:
সিস্টের লক্ষণ নির্ভর করে এর আকার, ধরন এবং অবস্থানের ওপর। কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- ব্যথা বা অস্বস্তি:
যদি সিস্ট বড় হয়ে যায় অথবা প্রদাহ সৃষ্টি করে, তাহলে এটি ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। স্তনে বা পেটে ব্যথা, সিস্টের সাধারণ লক্ষণ হতে পারে। - আকার পরিবর্তন বা ফোলাভাব:
সিস্ট সাধারণত ছোট এবং ব্যথাহীন হলেও, এটি যখন বড় হয়ে যায় তখন এটি আকারে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ব্রেস্ট বা ত্বকে এমন এক ধরনের ফুলে যাওয়ার অনুভূতি থাকতে পারে। - হরমোনাল পরিবর্তন:
অনেক সিস্ট হরমোনের প্রভাবে তৈরি হয়ে থাকে এবং এতে মাসিক চক্রে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। যেমন, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) এর কারণে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। - ভোগান্তি বা অস্বস্তি:
পেটে বা স্তনে সিস্ট থাকলে মাঝে মাঝে অস্বস্তি বা ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে যৌন সম্পর্কের সময়।
কখন সিস্ট চিন্তার কারণ হতে পারে?
সাধারণ সিস্ট ক্ষতিকর নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে:
- সিস্ট দ্রুত বড় হতে থাকলে
- অতিরিক্ত ব্যথা হলে
- সিস্ট থেকে পুঁজ বা রক্ত বের হলে
- খাওয়া-দাওয়া বা শ্বাসকষ্টে প্রভাব ফেললে
- দীর্ঘ সময় ধরে না কমলে
এমন ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সিস্টের চিকিৎসা ও প্রতিকার:
সিস্টের চিকিৎসা সিস্টের ধরণ, আকার এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি:
- অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:
যদি সিস্টের কারণ ইনফেকশন হয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হতে পারে। এটি সিস্টের প্রদাহ বা ব্যথা কমাতে সহায়ক হতে পারে। - ওভার দ্য কাউন্টার (OTC) মেডিসিন:
কিছু সাধারণ ব্যথার জন্য যেমন পেইন কিলার বা এনএসএআইডি (NSAIDs) ব্যবহার করা যেতে পারে। - অস্ত্রোপচার:
যদি সিস্ট বড় হয়ে যায় বা অন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে, তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সিস্ট অপসারণ করা হতে পারে। সাধারণত ত্বকের নিচে থাকা সিস্টগুলো অপসারণ করা হয়। - প্যাম্পিং বা ড্রেনিং:
বড় হয়ে যাওয়ার ফলে সিস্টের ভিতরের তরল বা পদার্থ বের করার জন্য ড্রেনিং প্রক্রিয়া হতে পারে। - ওভারিয়ান সিস্টের জন্য পর্যবেক্ষণ:
বেশিরভাগ সময়, ওভারিয়ান সিস্ট নিরীহ এবং কিছু মাসের মধ্যে চলে যায়, তাই এটি শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে।
সিস্ট নির্ণয়:
সিস্ট নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার সাধারণত নিচের পরীক্ষাগুলো করে থাকেন:
- শারীরিক পরীক্ষা
- আল্ট্রাসনোগ্রাম (Ultrasound)
- এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান
- এমআরআই
- বায়োপসি (ক্যানসারের সন্দেহ হলে)
সিস্ট হলে কি খাওয়া উচিত?
সঠিক খাদ্যাভ্যাস সিস্ট নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে:
- বেশি পরিমাণে শাকসবজি ও ফল
- আঁশযুক্ত খাবার
- পর্যাপ্ত পানি
- কম তেল-চর্বিযুক্ত খাবার
- প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও লবণ এড়ানো
উপসংহার:
সিস্ট একটি সাধারণ সমস্যা হলেও সঠিক সচেতনতা না থাকলে অনেকেই অকারণে ভয় পান। মনে রাখতে হবে, সিস্ট সবসময় বিপজ্জনক নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি সহজে চিকিৎসা করা যায়। তবে হঠাৎ আকার বড় হয়ে গেলে, ব্যথা হলে বা অন্য জটিল উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
সঠিক জীবনযাপন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সিস্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়।