সিস্ট কি টিউমার

সিস্ট কি টিউমার? আলোচনা করা হলো

প্রায়শই আমরা সিস্ট এবং টিউমার শব্দ দুটি শুনে থাকি এবং এদের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ি। অনেকে মনে করেন সিস্ট মানেই ক্যান্সার বা টিউমার। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। সিস্ট এবং টিউমার দুটোই শরীরের বিভিন্ন অংশে অস্বাভাবিক পিণ্ড বা বৃদ্ধি, কিন্তু এদের গঠন, কারণ এবং চিকিৎসা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে।

আমরা এই ব্লগ পোস্টে সিস্ট এবং টিউমারের মধ্যেকার মূল পার্থক্যগুলো সহজ ও সরল ভাষায় তুলে ধরব, যাতে আপনার বিভ্রান্তি দূর হয় এবং আপনি সঠিক তথ্যটি জানতে পারেন।

সিস্ট কি? (What is a Cyst?)

সিস্ট হলো এক ধরনের অস্বাভাবিক থলি বা পিণ্ড যা শরীরের যেকোনো অংশে তৈরি হতে পারে। এর ভেতরে সাধারণত তরল, বাতাস, বা আধা-কঠিন পদার্থ (যেমন পুঁজ) ভরা থাকে। সিস্টের একটি নির্দিষ্ট দেয়াল বা ক্যাপসুল থাকে যা এটিকে আশেপাশের টিস্যু থেকে আলাদা করে রাখে।

সিস্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • গঠন: এটি একটি থলির মতো, যার ভেতরে তরল বা অর্ধ-তরল পদার্থ থাকে।
  • প্রকৃতি: বেশিরভাগ সিস্টই ক্ষতিকর নয় (বেনাইন) এবং সাধারণত ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না।
  • আকার: ছোট থেকে বড় যেকোনো আকারের হতে পারে।
  • কারণ: সিস্ট বিভিন্ন কারণে তৈরি হতে পারে, যেমন:
    • অবরুদ্ধ নালী: কোনো গ্রন্থি বা নালী বন্ধ হয়ে গেলে তার ভেতরে তরল জমে সিস্ট তৈরি হতে পারে। যেমন – সেবাসিয়াস সিস্ট।
    • সংক্রমণ: সংক্রমণের কারণে পুঁজ জমে সিস্ট তৈরি হতে পারে।
    • বংশগত: কিছু সিস্ট বংশগত কারণে হতে পারে, যেমন – পলিসিস্টিক কিডনি রোগ।
    • ক্ষত: আঘাত বা ক্ষতের কারণে টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে সিস্ট হতে পারে।

কিছু সাধারণ সিস্টের উদাহরণ:

  • ওভারিয়ান সিস্ট: মেয়েদের ডিম্বাশয়ে তৈরি হওয়া সিস্ট। বেশিরভাগই ক্ষতিকর নয়।
  • সেবাসিয়াস সিস্ট: ত্বকের নিচে তেল গ্রন্থি (sebaceous gland) বন্ধ হয়ে গেলে হয়।
  • বেকারস সিস্ট: হাঁটুতে তৈরি হয়।
  • স্তনের সিস্ট: স্তনের টিস্যুতে তরল জমে তৈরি হয়, সাধারণত ক্ষতিকর নয়।

টিউমার কি? (What is a Tumor?)

টিউমার হলো কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যা একটি পিণ্ড বা ভর তৈরি করে। টিউমার মূলত কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়। টিউমারের ভেতরে কোনো তরল পদার্থ থাকে না, এটি মূলত টিস্যুর একটি কঠিন পিণ্ড।

টিউমারের প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • গঠন: এটি কঠিন টিস্যুর একটি পিণ্ড। এর কোনো নির্দিষ্ট থলির মতো দেয়াল থাকে না।
  • প্রকৃতি: টিউমার দু’ধরনের হতে পারে:
    • ক্ষতিকর নয় (Benign Tumor): এই ধরনের টিউমার শরীরের অন্য অংশে ছড়ায় না এবং সাধারণত ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না। এটি সাধারণত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা যায়।
    • ক্ষতিকর (Malignant Tumor): এই ধরনের টিউমার হলো ক্যান্সার। এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, আশেপাশের টিস্যু আক্রমণ করে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে (মেটাস্ট্যাসিস)।
  • আকার: এটিও ছোট থেকে বড় যেকোনো আকারের হতে পারে।
  • কারণ: টিউমারের কারণ এখনো সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি, তবে কিছু কারণ হলো:
    • বংশগত: কিছু টিউমার বংশগত কারণে হয়।
    • পরিবেশগত: দূষণ, রেডিয়েশন বা রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসা।
    • জীবনযাত্রার ধরন: ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন।
    • ভাইরাস: কিছু ভাইরাস টিউমারের কারণ হতে পারে।

সিস্ট কি টিউমার মধ্যে মূল পার্থক্য: একটি তুলনামূলক ছক

বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি

সিস্ট (Cyst)

টিউমার (Tumor)

গঠন

একটি থলির মতো, ভেতরে তরল বা অর্ধ-তরল পদার্থ থাকে।

কঠিন টিস্যুর একটি পিণ্ড, কোনো থলি থাকে না।

প্রকৃতি

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর নয় (বেনাইন)।

বেনাইন (ক্ষতিকর নয়) অথবা ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সার) হতে পারে।

বৃদ্ধি

সাধারণত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় বা আকার অপরিবর্তিত থাকে।

বেনাইন টিউমার ধীরে বাড়ে, ম্যালিগন্যান্ট টিউমার দ্রুত বাড়ে।

ছড়িয়ে পড়া

শরীরের অন্য অংশে ছড়ায় না।

ম্যালিগন্যান্ট টিউমার (ক্যান্সার) শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

চিকিৎসা

সাধারণত নিষ্কাশন (drainage) বা অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয়।

বেনাইন টিউমার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের জন্য কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।

সিস্টের লক্ষণ:

  • চামড়ার নিচে ছোট গোলাকার ফোলা।

  • সাধারণত ব্যথাহীন, তবে সংক্রমিত হলে ব্যথা হতে পারে।

  • ফোলা অংশে লালচে ভাব ও পুঁজ জমা হতে পারে।

  • সিস্ট বড় হলে অস্বস্তি বা চাপ অনুভূত হতে পারে।

টিউমারের লক্ষণ:

  • শরীরে নতুন কোনো গাঁট বা মাংসপিণ্ড দেখা দেয়।

  • অনেক সময় ব্যথাহীন হলেও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

  • আশেপাশের অঙ্গের কার্যক্ষমতায় সমস্যা করতে পারে।

  • ম্যালিগন্যান্ট হলে ওজন কমা, ক্লান্তি, রক্তপাত, স্থায়ী ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?

যদি আপনার শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পিণ্ড, ফোলা বা ব্যথা অনুভব করেন, তবে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিস্ট ক্ষতিকর নয়, তবে এটি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

চিকিৎসক আপনার শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং প্রয়োজনে আল্ট্রাসাউন্ড, এমআরআই, সিটি স্ক্যান বা বায়োপসি (টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা) করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পিণ্ডটি সিস্ট নাকি টিউমার এবং এটি ক্ষতিকর কিনা।

  • যদি গাঁট দ্রুত বড় হয়।

  • দীর্ঘদিন একই থাকে কিন্তু কমে না।

  • ব্যথা, লালচে ভাব বা পুঁজ হয়।

  • খাওয়া, শ্বাস নেওয়া বা চলাফেরায় সমস্যা করে।

  • শরীরে একাধিক নতুন গাঁট দেখা দেয়।

ডায়াগনোসিস বা পরীক্ষা:

ডাক্তার শারীরিক পরীক্ষা ও বিভিন্ন টেস্টের মাধ্যমে নির্ধারণ করেন সিস্ট না টিউমার।

  • আল্ট্রাসাউন্ড – সিস্টের ভেতরে তরল আছে কিনা তা দেখা যায়।

  • সিটি স্ক্যান বা এমআরআই – টিউমারের আকার ও প্রকৃতি বোঝা যায়।

  • বায়োপসি – টিউমার ক্যান্সার কিনা তা নির্ধারণে কোষ পরীক্ষা।

  • ব্লাড টেস্ট – কিছু ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়।

প্রতিরোধের উপায়:

যদিও সব ধরনের সিস্ট বা টিউমার প্রতিরোধ করা যায় না, তবে কিছু অভ্যাস ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

  • স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া।

  • ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়ানো।

  • নিয়মিত ব্যায়াম করা।

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।

  • শরীরে নতুন কোনো গাঁট দেখলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

সব সিস্ট কি বিপজ্জনক?

না, বেশিরভাগ সিস্ট নিরীহ। তবে সংক্রমণ হলে চিকিৎসা দরকার।

টিউমার মানেই কি ক্যান্সার?

না, সব টিউমার ক্যান্সার নয়। অনেক টিউমার বিনাইন হয়।

সিস্ট কি নিজে নিজেই চলে যায়?

ছোট ও সাধারণ সিস্ট অনেক সময় চিকিৎসা ছাড়াই চলে যায়।

সিস্ট ও টিউমারের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে বুঝব?

ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড, এমআরআই বা বায়োপসির মাধ্যমে তা নির্ধারণ করেন।

উপসংহার:

সিস্ট এবং টিউমার দুটোই শরীরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলেও এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। একটি হলো তরল বা অর্ধ-তরল ভরা থলি, অন্যটি হলো কঠিন টিস্যুর পিণ্ড। বেশিরভাগ সিস্টই ক্ষতিকর নয়, কিন্তু সব টিউমার ক্ষতিকর না হলেও কিছু টিউমার ক্যান্সার হতে পারে। তাই, নিজের শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে ভয় না পেয়ে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। সঠিক রোগ নির্ণয় এবং সময়মতো চিকিৎসা আপনার সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে পারে। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো অনুমান না করে বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।

Scroll to Top