সিস্ট হলে কি বাচ্চা হয় না

সিস্ট হলে কি বাচ্চা হয় না?

অনেক নারী যখন ডিম্বাশয়ে (Ovary) সিস্ট ধরা পড়ে, তখন তাদের মনে প্রথম যে প্রশ্ন জাগে তা হলো – “সিস্ট হলে কি বাচ্চা হয় না?”। এটি খুব স্বাভাবিক একটি দুশ্চিন্তা। তবে সব ধরনের সিস্টই বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করে না। কিছু সিস্ট স্বাভাবিকভাবে সেরে যায়, আবার কিছু সিস্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তাই এই বিষয়টি নিয়ে সঠিক তথ্য জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই ব্লগে আমরা সহজ ভাষায় আলোচনা করবো – সিস্ট আসলে কী, কোন সিস্টে গর্ভধারণে সমস্যা হয়, চিকিৎসা কীভাবে হয় এবং সন্তানধারণের সম্ভাবনা কতটুকু।

সিস্ট কি? (What is a Cyst?)

সিস্ট হলো শরীরের কোনো অংশে তরল, বাতাস বা অন্য কোনো পদার্থ দিয়ে পূর্ণ একটি থলির মতো গঠন। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে হতে পারে, তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত ডিম্বাশয়ে (Ovary) দেখা যায়, যা ওভারিয়ান সিস্ট নামে পরিচিত। ওভারিয়ান সিস্ট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং এদের বেশিরভাগই সাধারণত ক্ষতিকর নয়।

ডিম্বাশয়ের সিস্টের সাধারণ ধরন:

  1. ফাংশনাল সিস্ট (Functional Cyst):

     

    • সবচেয়ে সাধারণ এবং ক্ষতিকর নয়।

       

    • এটি মাসিক চক্রের সময় তৈরি হয় এবং সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যে নিজে নিজেই সেরে যায়।

       

  2. ডার্ময়েড সিস্ট (Dermoid Cyst):

     

    • ভেতরে চুল, দাঁত বা চামড়ার মতো টিস্যু থাকতে পারে।

       

    • এটি সাধারণত সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করতে হয়।

       

  3. সিস্ট্যাডেনোমা (Cystadenoma):

     

    • তরল ভরা বড় ধরনের সিস্ট, যা ডিম্বাশয়ের বাইরের দিকে হয়।

       

  4. এন্ডোমেট্রিওমা (Endometrioma):

     

    • যেসব মহিলার এন্ডোমেট্রিওসিস আছে তাদের মধ্যে হয়।

       

    • এটি গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

       

  5. পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS):

     

    • ডিম্বাশয়ে অনেক ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়।

       

  • মাসিক অনিয়মিত হয় এবং সন্তানধারণে সমস্যা হতে পারে।

সিস্ট হলে কি বাচ্চা হয় না? ভয় নয়, সঠিক তথ্য জানুন

সিস্ট হলেই যে বাচ্চা হবে না, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এটি নির্ভর করে সিস্টের ধরন, আকার এবং এর কারণে কোনো জটিলতা তৈরি হচ্ছে কিনা তার উপর।

১. বেশিরভাগ সিস্টই নিরীহ (Functional Cysts):

প্রায় ৮০-৯০% ওভারিয়ান সিস্ট হলো ফাংশনাল সিস্ট (Functional Cysts)। এগুলো মাসিক চক্রের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে তৈরি হয় এবং সাধারণত কয়েক মাস পর নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়।

  •         ফোলিকুলার সিস্ট (Follicular Cyst): এটি ডিম্বাণু ছাড়ার (ovulation) আগে তৈরি হয় এবং বেশিরভাগ সময় এটি কোনো লক্ষণ ছাড়াই সেরে যায়।
  •         কর্পাস লুটিয়াম সিস্ট (Corpus Luteum Cyst): ডিম্বাণু ছাড়ার পর এটি তৈরি হয় এবং গর্ভধারণে সাহায্য করতে পারে। গর্ভধারণ না হলে এটিও নিজে থেকে মিলিয়ে যায়।

এই ধরনের সিস্টগুলো সাধারণত উর্বরতা বা গর্ভধারণের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না।

২. কিছু সিস্ট যা গর্ভধারণে প্রভাব ফেলতে পারে:

কিছু নির্দিষ্ট ধরনের সিস্ট আছে যা গর্ভধারণে কিছুটা সমস্যা তৈরি করতে পারে।

  •         এন্ডোমেট্রিওমা (Endometrioma): এই ধরনের সিস্টকে ‘চকোলেট সিস্ট’ বলা হয়। এটি এন্ডোমেট্রিওসিস নামক একটি রোগের কারণে হয়, যেখানে জরায়ুর টিস্যু জরায়ুর বাইরে বৃদ্ধি পায়। এন্ডোমেট্রিওমা ডিম্বাশয় বা ডিম্বনালীতে ক্ষতি করতে পারে, যা গর্ভধারণ কঠিন করে তোলে।
  •         ডার্ময়েড সিস্ট (Dermoid Cyst): এটি সাধারণত সৌম্য (benign) হয়, কিন্তু আকারে বড় হলে ডিম্বাশয়ের আকৃতি বা কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে, যা উর্বরতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
  •         পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) সম্পর্কিত সিস্ট: PCOS একটি হরমোনজনিত সমস্যা, যেখানে ডিম্বাশয়ে অনেক ছোট ছোট সিস্ট থাকে। PCOS এর কারণে অনিয়মিত মাসিক হয় বা ডিম্বাণু উৎপাদনে সমস্যা হয়, যা গর্ভধারণে বাধা দিতে পারে।

৩. সিস্টের আকার ও সংখ্যা:

সিস্টের আকার এবং সংখ্যাও গর্ভধারণের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। ছোট ও একটি মাত্র সিস্ট সাধারণত কোনো সমস্যা করে না। কিন্তু যদি সিস্টগুলো খুব বড় হয়, তবে এটি ডিম্বাশয়ের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে। যদি একাধিক সিস্ট থাকে, যেমন PCOS এর ক্ষেত্রে, তবে ডিম্বাণু উৎপাদন নিয়মিত হয় না।

৪. চিকিৎসা এবং গর্ভধারণ:

কিছু ক্ষেত্রে সিস্টের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

  •         ওষুধ: হরমোন ভারসাম্যহীনতার কারণে সৃষ্ট সিস্টের জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
  •         সার্জারি: যদি সিস্ট খুব বড় হয়, ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করে, বা ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তবে তা অপসারণের জন্য সার্জারি করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সার্জারি ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে করা হয়, যা খুবই কম ক্ষতিকর। সিস্ট অপসারণের পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা প্রায়শই স্বাভাবিক হয়ে যায়।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

আপনি যদি সিস্ট নিয়ে চিন্তিত হন বা গর্ভধারণে সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন, তাহলে একজন গাইনি ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা খুবই জরুরি। ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড বা অন্য পরীক্ষার মাধ্যমে সিস্টের ধরন ও অবস্থা নির্ণয় করবেন এবং সেই অনুযায়ী উপযুক্ত পরামর্শ দেবেন।

  •         যদি আপনি মাসিক চক্রের সময় তীব্র ব্যথা অনুভব করেন।
  •         মাসিক অনিয়মিত হয় বা বন্ধ হয়ে যায়।
  •         পেটে বা তলপেটে ফোলাভাব বা ব্যথা হয়।
  •         যদি আপনি দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও গর্ভধারণে ব্যর্থ হন।

সিস্টের লক্ষণ:

  • পেটের নিচে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা।

  • মাসিক অনিয়ম।

  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা খুব কম রক্তক্ষরণ।

  • পেট ফেঁপে থাকা বা ভারী লাগা।

  • কখনো কখনো কোনো লক্ষণ ছাড়াও সিস্ট থাকতে পারে।

সিস্ট প্রতিরোধে করণীয়:

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।

  • স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া (শাকসবজি, ফলমূল, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার)।

  • ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা।

  • নিয়মিত ব্যায়াম করা।

  • মাসিক চক্র অনিয়ম হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

সিস্ট থাকলে কি গর্ভবতী হওয়া অসম্ভব?

না, একেবারেই নয়। অনেক মহিলা সিস্ট থাকার পরও স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করতে পারেন। তবে কিছু ধরনের সিস্ট চিকিৎসা ছাড়া সমস্যা করতে পারে।

সিস্ট থাকলে কি সিজারিয়ান করতে হবে?

সবসময় নয়। গর্ভাবস্থার সময় সিস্টের আকার ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেবেন।

সিস্ট নিজে নিজে কমে যেতে পারে কি?

হ্যাঁ, অনেক ফাংশনাল সিস্ট কয়েক মাসের মধ্যে নিজে নিজেই কমে যায়।

সিস্ট থাকলে কি বন্ধ্যাত্ব স্থায়ী হয়ে যায়?

না। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে।

সিস্ট হলে কি সব সময় ব্যথা হয়?

না, বেশিরভাগ সিস্ট কোনো ব্যথা সৃষ্টি করে না। ব্যথা বা অস্বস্তি সাধারণত তখনই হয় যখন সিস্টটি বড় হয়, ফেটে যায় বা ডিম্বাশয়কে মোচড় দেয়।

সিস্ট কি ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে?

বেশিরভাগ ওভারিয়ান সিস্ট সৌম্য (benign)। কিছু বিরল ক্ষেত্রে সিস্ট ক্যান্সারযুক্ত হতে পারে, কিন্তু সাধারণত তা ৫০ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের মধ্যে দেখা যায়।

গর্ভধারণের পর কি সিস্ট হতে পারে?

হ্যাঁ, গর্ভধারণের প্রথম দিকে কর্পাস লুটিয়াম সিস্ট হতে পারে, যা গর্ভধারণের সহায়ক এবং সাধারণত ক্ষতিকর নয়।

সিস্ট প্রতিরোধ করা যায় কি?

বেশিরভাগ সিস্ট প্রতিরোধ করা কঠিন, কারণ এগুলো হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস শরীরের হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।

উপসংহার:

সুতরাং, “সিস্ট হলেই বাচ্চা হয় না”, এই ধারণাটি একটি ভুল ধারণা। বেশিরভাগ সিস্টই নিরীহ এবং গর্ভধারণে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিছু নির্দিষ্ট ধরনের সিস্ট উর্বরতাকে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু সঠিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভধারণের সম্ভাবনা অনেকটাই স্বাভাবিক করা যায়।

মনে রাখবেন, কোনো শারীরিক সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। ডাক্তার আপনার অবস্থা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে এবং আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পথনির্দেশনা দিতে পারবেন। আপনার সুস্থ জীবন কামনা করছি।

সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।

Scroll to Top