সিস্ট হলে কি সমস্যা হয়

সিস্ট হলে কি সমস্যা হয়? আলোচনা করা হলো

আমাদের শরীরের যেকোনো স্থানেই সিস্ট হতে পারে। এটি এক ধরনের থলির মতো গঠন, যার ভেতর তরল, অর্ধ-কঠিন বা বায়ু ভরা থাকে। সিস্টের নাম শুনলেই অনেকে ভয় পেয়ে যান, কিন্তু বেশিরভাগ সিস্টই ক্ষতিকর বা ক্যান্সারজনিত হয় না। তবে, সিস্টের অবস্থান এবং আকারের ওপর ভিত্তি করে এটি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা সহজ ভাষায় আলোচনা করব সিস্ট কী, কেন হয় এবং সিস্ট হলে কী কী সাধারণ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই তথ্যগুলো পরিবারের সবার জন্য সহায়ক হবে এবং কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে সাহায্য করবে।

সিস্ট আসলে কি?

সিস্ট হলো শরীরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা থলির মতো একটি গঠন। এটি শরীরের প্রায় যেকোনো অংশে হতে পারে, যেমন- ত্বক, ডিম্বাশয় (ওভারি), কিডনি, লিভার, স্তন এবং মস্তিষ্কে। সিস্টের আকার খুব ছোট থেকে অনেক বড় পর্যন্ত হতে পারে। কিছু সিস্ট জন্মগতভাবে থাকে, আবার কিছু জীবনকালে বিভিন্ন কারণে তৈরি হয়।

সিস্ট সাধারণত নিরীহ (benign), অর্থাৎ ক্যান্সারজনিত নয়। তবে কিছু সিস্ট অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা বড় হতে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

সিস্ট হলে কি সমস্যা হয়?

সিস্টের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো নির্ভর করে এর অবস্থান, আকার এবং এটি কোনো অঙ্গের ওপর চাপ দিচ্ছে কি না তার ওপর। নিচে কয়েকটি সাধারণ সমস্যা তুলে ধরা হলো:

১. ব্যথা এবং অস্বস্তি:

অনেক সময় সিস্টের কারণে কোনো ব্যথা হয় না, বিশেষ করে যদি এটি ছোট হয়। কিন্তু যখন সিস্ট বড় হতে শুরু করে অথবা এটি কোনো সংবেদনশীল স্নায়ু বা অঙ্গের ওপর চাপ দেয়, তখন ব্যথা হতে পারে।

  •         কেন হয়: সিস্টের আকার বড় হলে তার আশেপাশের টিস্যুগুলোতে টান পড়ে বা চাপ সৃষ্টি হয়, যা ব্যথার কারণ।
  •         উদাহরণ:

o    ডিম্বাশয়ের সিস্ট (Ovarian Cyst): পেটের নিচের দিকে বা পেলভিক অঞ্চলে ব্যথা হতে পারে। ব্যথা হালকা থেকে তীব্র হতে পারে, বিশেষ করে মাসিকের সময় বা শারীরিক সম্পর্কের সময়।

o    বেকারস সিস্ট (Baker’s Cyst): এটি হাঁটুর পেছনে হয় এবং হাঁটুকে বাঁকানোর সময় ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে।

o    পিঠের সিস্ট: মেরুদণ্ডের কাছাকাছি সিস্ট হলে স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে এবং পিঠে ব্যথা বা অসাড়তা সৃষ্টি হতে পারে।

২. ফোলাভাব বা দৃশ্যমান পিণ্ড:

ত্বকের নিচে বা পেশীর ভেতর সিস্ট হলে সেটি বাইরে থেকে দৃশ্যমান হতে পারে।

  •         কেন হয়: সিস্টের ভেতর তরল বা অন্য পদার্থ জমা হওয়ায় এটি একটি পিণ্ড বা গোটার মতো আকার ধারণ করে।
  •         উদাহরণ:

o    এপিডার্ময়েড সিস্ট (Epidermoid Cyst): ত্বকের নিচে একটি ছোট পিণ্ড বা গোটার মতো দেখা যায়।

o    গ্যাংলিয়ন সিস্ট (Ganglion Cyst): এটি কব্জি বা গোড়ালির জয়েন্টের কাছে শক্ত পিণ্ডের মতো দেখা যায়।

৩. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতায় প্রভাব:

যদি সিস্ট কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ওপর চাপ দেয় বা তার কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করে, তবে তা জটিলতা তৈরি করতে পারে।

  •         কেন হয়: বড় সিস্টের আকার এমন হয় যে এটি অঙ্গের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত করে।
  •         উদাহরণ:

o    কিডনির সিস্ট: যদি একটি বড় সিস্ট কিডনির ওপর চাপ দেয়, তবে এটি কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।

o    ডিম্বাশয়ের সিস্ট: বড় সিস্ট হলে ডিম্বাশয় পেঁচিয়ে যেতে পারে (Ovarian Torsion), যা তীব্র ব্যথা এবং জরুরি চিকিৎসার কারণ।

o    মস্তিষ্কের সিস্ট: বিরল হলেও, মস্তিষ্কের কোনো সিস্ট স্নায়ুর ওপর চাপ দিলে মাথাব্যথা, বমি, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, এমনকি খিঁচুনির মতো গুরুতর সমস্যা হতে পারে।

৪. সংক্রমণ:

কিছু ক্ষেত্রে সিস্টের ভেতর ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

  •         কেন হয়: সিস্টের ভেতর তরল জমে থাকায় এটি সংক্রমণের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ।
  •         উদাহরণ: ত্বকের সিস্ট সংক্রমিত হলে এটি লাল, ফোলা এবং গরম হয়ে যেতে পারে এবং পুঁজ জমা হতে পারে।

৫. হরমোন ভারসাম্যহীনতা:

কিছু সিস্ট, বিশেষ করে ওভারিয়ান সিস্ট, হরমোন উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে।

  •         কেন হয়: এই ধরনের সিস্ট হরমোন উৎপাদনকারী টিস্যু থেকে তৈরি হতে পারে, যা শরীরের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে।
  •         উদাহরণ: পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) এ অনেক ছোট সিস্ট তৈরি হয়, যা অনিয়মিত মাসিক, ওজন বৃদ্ধি, ব্রণ এবং শরীরের অবাঞ্ছিত লোম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

৬. রক্তপাত:

কিছু সিস্ট ফেটে গেলে শরীরের ভেতরে বা বাইরে রক্তপাত হতে পারে।

  •         কেন হয়: বড় বা দুর্বল প্রাচীরযুক্ত সিস্ট আঘাত পেলে বা অন্য কোনো কারণে ফেটে যেতে পারে।
  •         উদাহরণ: ওভারিয়ান সিস্ট ফেটে গেলে পেটে তীব্র ব্যথা এবং অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হতে পারে, যা একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

যেহেতু বেশিরভাগ সিস্টই নিরীহ, তাই অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। তবে কিছু লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:

  •         আকস্মিক ও তীব্র ব্যথা: যদি সিস্টের অবস্থানে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়।
  •         আকৃতির পরিবর্তন: সিস্টটি দ্রুত বড় হচ্ছে বা তার আকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে।
  •         সংক্রমণের লক্ষণ: সিস্টের জায়গাটি লাল, গরম, ফোলা এবং ব্যথার সাথে জ্বর হলে।
  •         অন্যান্য উপসর্গ: যদি সিস্টের কারণে শ্বাস নিতে অসুবিধা, খাবার গিলতে সমস্যা, বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত লক্ষণ দেখা যায়।

সিস্টের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ:

সিস্টের চিকিৎসা নির্ভর করে এর ধরন এবং অবস্থানের ওপর।

  •         পর্যবেক্ষণ: অনেক ছোট এবং নিরীহ সিস্টের ক্ষেত্রে চিকিৎসক শুধু পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দেন।
  •         ড্রেনেজ: কিছু সিস্ট, বিশেষ করে ত্বকের সিস্ট, ড্রেনেজ বা পানি বের করে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
  •         সার্জারি: বড় বা সমস্যা সৃষ্টিকারী সিস্ট সার্জারি করে অপসারণ করা হয়।
  •         ওষুধ: কিছু সিস্টের চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

সিস্ট প্রতিরোধ করা সবসময় সম্ভব নয়। তবে সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখলে কিছু সিস্ট হওয়ার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের সিস্ট এবং তাদের চিকিৎসা:

  •         এপিডার্ময়েড সিস্ট (Epidermoid Cyst): ত্বকের নিচে তৈরি হয়। সাধারণত ছোট এবং ক্ষতিকর নয়। গরম সেঁক এবং সার্জারি সাধারণ চিকিৎসা।
  •         ওভারিয়ান সিস্ট (Ovarian Cyst): ডিম্বাশয়ে তৈরি হয়। বেশিরভাগই নিজে থেকে চলে যায়। তবে বড় বা ব্যথাযুক্ত হলে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
  •         ব্রেস্ট সিস্ট (Breast Cyst): স্তনে তৈরি হয়। এটি সাধারণত নিরীহ। সূঁচ দিয়ে তরল বের করে ফেলা বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
  •         কিডনি সিস্ট (Kidney Cyst): কিডনিতে তৈরি হয়। বেশিরভাগ সময় কোনো চিকিৎসা লাগে না, তবে বড় হলে বা জটিলতা সৃষ্টি করলে ড্রেনেজ বা সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

সিস্ট হলে কি হয়?

সিস্ট হলে শরীরে অস্বাভাবিক ফোলা বা গুটি তৈরি হয়, যা ব্যথা, ফোলাভাব, চাপের অনুভূতি বা হরমোনজনিত সমস্যার কারণ হতে পারে। অনেক সময় এটি ক্ষতিকর নয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

ডিম্বাশয়ে সিস্ট হলে কি সমস্যা হয়?

ডিম্বাশয়ে সিস্ট হলে মাসিক অনিয়ম, পেট ব্যথা, ফোলা অনুভব, ও বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়তে পারে। বড় আকারের সিস্ট ফেটে গেলে তীব্র পেট ব্যথা হতে পারে।

কিডনিতে সিস্ট হলে কি হয়?

কিডনিতে সিস্ট হলে প্রস্রাবে রক্ত আসা, কোমর ব্যথা, বারবার প্রস্রাবের প্রবণতা বা উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে বড় সিস্ট কিডনির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

সিস্ট কি ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে?

সাধারণত বেশিরভাগ সিস্ট ক্ষতিকর নয় এবং ক্যান্সারে রূপ নেয় না। তবে কিছু জটিল সিস্ট (বিশেষ করে ডিম্বাশয় বা স্তনে) ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এজন্য নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

সিস্ট হলে চিকিৎসা কিভাবে করা হয়?

সিস্টের চিকিৎসা নির্ভর করে এর আকার, অবস্থান ও ধরন অনুযায়ী। ছোট ও ক্ষতিকর নয় এমন সিস্ট অনেক সময় নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে বড় সিস্ট বা সমস্যা তৈরি করলে ওষুধ বা অস্ত্রোপচার (সার্জারি) লাগতে পারে।

সিস্ট প্রতিরোধ করা যায় কি?

সব সিস্ট প্রতিরোধ করা যায় না। তবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান, হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে অনেক জটিল সিস্ট এড়ানো সম্ভব।

উপসংহার:

সিস্ট একটি সাধারণ শারীরিক অবস্থা যা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি নিরীহ এবং কোনো বড় সমস্যা সৃষ্টি করে না। তবে, যদি সিস্টের কারণে ব্যথা, আকার বৃদ্ধি, বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত লক্ষণ দেখা যায়, তবে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা যেকোনো জটিলতা এড়াতে সাহায্য করতে পারে।

সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন।

Scroll to Top