
স্ক্যাবিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা:
স্ক্যাবিস (Scabies) একটি চর্মরোগ যা ছোট একটি পরজীবী কীটের কারণে হয়, যার নাম Sarcoptes scabiei। এই পোকাটি মানব ত্বকের নিচে গর্ত করে এবং সেখানে ডিম পাড়ে, যার ফলে তীব্র চুলকানি এবং ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ, অর্থাৎ একজন ব্যক্তি থেকে অন্যজনের দেহে ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা এই ব্লগে স্ক্যাবিস কী, এটি কীভাবে ছড়ায়, লক্ষণ কী, চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রতিরোধ এবং ঘরোয়া কিছু করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
স্ক্যাবিস কি?
স্ক্যাবিস (Scabies) হলো একটি চর্মরোগ যা সারকোপটেস স্ক্যাবেই (Sarcoptes scabiei) নামক ক্ষুদ্র মাইটের কারণে হয়। এই পরজীবী ত্বকের নিচে বাসা বাঁধে এবং ডিম পাড়ে, যার ফলে তীব্র চুলকানি ও ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এটি খুব দ্রুত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে, বিশেষ করে যেখানে লোকজন ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করে (যেমন—পরিবার, হোস্টেল, স্কুল ইত্যাদি)।
স্ক্যাবিস কিভাবে হয়?
স্ক্যাবিস রোগ Sarcoptes scabiei নামক অতি ক্ষুদ্র একটি পরজীবীর কারণে হয়। এই পরজীবী মানব ত্বকে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে ডিম পাড়ে। এতে আক্রান্ত স্থানে তীব্র চুলকানি শুরু হয়, বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময় বেশি অনুভূত হয়।
স্ক্যাবিস কীভাবে ছড়ায়?
স্ক্যাবিস রোগ সহজেই একজন থেকে আরেকজনের মাঝে ছড়াতে পারে। মূলতঃ এটি ছড়ায়:
- সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শে এলে
- একসঙ্গে বিছানায় শোয়া
- সংক্রামিত ব্যক্তির ব্যবহৃত পোশাক, তোয়ালে বা চাদর ব্যবহারে
- শিশুদের ক্ষেত্রে স্কুল, ডে-কেয়ার সেন্টার বা খেলাধুলার মাধ্যমে
- অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায়
স্ক্যাবিস কোন বয়স, লিঙ্গ বা শ্রেণিকে বেছে দেখে না। সবাই এতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা যারা অনেক মানুষের সঙ্গে একই ঘরে থাকেন (যেমন হোস্টেল, কারাগার, রিফিউজি ক্যাম্প), তাদের ঝুঁকি বেশি।
স্ক্যাবিসের লক্ষণ:
স্ক্যাবিসের লক্ষণ সাধারণত সংক্রমণের ২-৬ সপ্তাহ পর দেখা দেয়। তবে যারা আগে কখনো স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেরিতে প্রকাশ পেতে পারে।
প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- তীব্র চুলকানি, বিশেষ করে রাতের বেলা
- লাল ফুসকুড়ি বা দানা (হাতের আঙুলের ফাঁক, কব্জি, কোমর, নাভির চারপাশ, বগল, যৌনাঙ্গে বেশি দেখা যায়)
- ছোট ছোট সুরঙ্গের মতো দাগ (মাইট ত্বকের নিচে গর্ত করে বলে এমন হয়)
- খোসা পড়া বা ঘা (অতিরিক্ত চুলকালে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়)
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্ক্যাবিসের লক্ষণ:
- মুখমণ্ডল, মাথার তালু, হাত-পায়ের তালুতে ফুসকুড়ি
- অতিরিক্ত বিরক্তি ও ঘুমের সমস্যা
কাদের বেশি ঝুঁকি থাকে?
- বাচ্চারা
- বৃদ্ধ ও শয্যাশায়ী রোগী
- ঘনিষ্ঠভাবে বাস করেন এমন পরিবার
- হোস্টেলে বা অনাথ আশ্রমে বসবাসকারীরা
- যৌন সহবাসে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
- চুলকানি অনেক দিন ধরে হচ্ছে
- রাতে ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে
- পরিবারের অন্য সদস্যরাও চুলকানিতে আক্রান্ত
- ঘায়ে পুঁজ হচ্ছে বা ইনফেকশনের লক্ষণ আছে
- দোকান থেকে কেনা মলমে কাজ হচ্ছে না
স্ক্যাবিসের চিকিৎসা:
স্ক্যাবিস সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য, তবে সঠিক ও পূর্ণ চিকিৎসা দরকার। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়:
১. স্ক্যাবিস মলম (Scabicide):
- পারমেথ্রিন (Permethrin) ৫% ক্রিম: সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা। এটি রাতে পুরো শরীরে লাগাতে হয়, গলা থেকে পা পর্যন্ত। শিশুদের ক্ষেত্রে মাথাতেও দিতে হতে পারে। ৮-১৪ ঘণ্টা পরে ধুয়ে ফেলতে হয়।
- বেনজাইল বেনজোয়েট (Benzyl Benzoate)
- সালফার অয়েন্টমেন্ট (Sulfur ointment): গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ বিকল্প।
২. ওরাল মেডিসিন:
- আইভারমেকটিন (Ivermectin): মুখে খাওয়ার ওষুধ, সাধারণত এক ডোজ এবং ৭ দিনের ব্যবধানে আরেকটি ডোজ দেওয়া হয়।
৩. চুলকানির জন্য:
- অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট (যেমন ফেক্সোফেনাডিন, সিটিরিজিন)
- ঠান্ডা লাগানো মলম বা লোশন
৪. ইনফেকশনের জন্য:
- ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে।
📌 গুরুত্বপূর্ণ: পরিবারের সব সদস্যকে একই সঙ্গে চিকিৎসা করা দরকার, এমনকি যদি তাদের কোনো লক্ষণ না-ও থাকে।
চিকিৎসার সময় যা মেনে চলতে হবে:
- সমস্ত শরীরে (গলা থেকে পা পর্যন্ত) মলম লাগাতে হবে
- চিকিৎসা চলাকালীন বিছানা চাদর, পোশাক গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে
- প্রতিদিন পোশাক ও বিছানা পাল্টানো ভালো
- পোকাটি ত্বকে না থাকলেও চুলকানি ২-৩ সপ্তাহ চলতে পারে
স্ক্যাবিসের ঘরোয়া চিকিৎসা:
ঔষধের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে স্ক্যাবিসের চুলকানি ও সংক্রমণ কমাতে পারেন:
১. নিম পাতা
নিমের অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক গুণ আছে। নিমের পাতা পিষে পেস্ট বানিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগালে উপকার পাবেন।
২. টি ট্রি অয়েল
এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক। তুলায় করে আক্রান্ত স্থানে লাগান (সাবধানতা: সরাসরি ত্বকে না লাগিয়ে অলিভ অয়েলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করুন)।
৩. হলুদ ও নারকেল তেল
হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ আছে। নারকেল তেলের সাথে হলুদ মিশিয়ে লাগালে চুলকানি কমবে।
৪. গরম পানি দিয়ে গোসল
গরম পানি মাইট কমাতে সাহায্য করে (তবে অতিরিক্ত গরম পানি ব্যবহার করবেন না, ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে)।
স্ক্যাবিস প্রতিরোধের উপায়:
স্ক্যাবিস যেহেতু খুব ছোঁয়াচে, তাই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
১. সংক্রমিত ব্যক্তির কাপড়-চোপড় গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন
- বিছানার চাদর, তোয়ালে, জামাকাপড় ৬০°C তাপমাত্রায় ধুয়ে নিন।
- যা ধোয়া সম্ভব নয় (যেমন—জুতা), তা প্লাস্টিক ব্যাগে ৩-৪ দিন বন্ধ করে রাখুন (মাইট মারা যাবে)।
২. পরিবারের সবাইকে একসাথে চিকিৎসা নিন
একজনের স্ক্যাবিস হলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও চিকিৎসা নেওয়া উচিত, যদিও তাদের লক্ষণ না থাকে।
৩. ব্যক্তিগত জিনিস আলাদা রাখুন
তোয়ালে, কাপড়, চিরুনি শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
৪. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
বাসায় নিয়মিত মেঝে মুছুন এবং বিছানা পরিষ্কার রাখুন।
শিশুদের ক্ষেত্রে স্ক্যাবিস:
শিশুরা সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং অনেক সময় তাদের মাথা, মুখ, হাত ও পায়ের তালুতেও ফুসকুড়ি দেখা যায়। শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন। পারমেথ্রিন বা সালফার অয়েন্টমেন্ট ব্যবহারে শিশুর বয়স অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্ক্যাবিস হলে কী করবেন না?
- বেশি করে চুলকাবেন না – এতে ইনফেকশন হতে পারে
- নিজের ইচ্ছামত ওষুধ ব্যবহার করবেন না
- রোগ গোপন করবেন না – পরিবারের অন্য সদস্যদের সতর্ক করুন
সচেতনতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি:
অনেক সময় স্ক্যাবিসকে লজ্জাজনক রোগ মনে করা হয়, যা একদমই ঠিক নয়। এটি একটি সাধারণ ছোঁয়াচে চর্মরোগ এবং চিকিৎসা করলে সহজেই ভালো হয়। তাই এটি গোপন না করে সচেতন হোন, পরিবার ও আশেপাশের মানুষদেরও সচেতন করুন।
স্ক্যাবিস সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা:
- স্ক্যাবিস শুধু গরীবদের হয়? → না, যেকোনো মানুষেরই হতে পারে।
- পরিষ্কার থাকলে স্ক্যাবিস হয় না? → পরিষ্কার থাকলেও সংস্পর্শে এলে হতে পারে।
- স্ক্যাবিস নিজে নিজে সেরে যায়? → না, চিকিৎসা নিতে হবে।
উপসংহার:
স্ক্যাবিস একটি বিরক্তিকর কিন্তু নিরাময়যোগ্য চর্মরোগ। সময়মতো চিকিৎসা, পরিবারের সবার চিকিৎসা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চুলকানি ও ফুসকুড়িকে হালকাভাবে না নিয়ে সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!