
স্ক্যাবিস এর লোশন গুলো কি কি?
স্ক্যাবিস (Scabies) বা চুলকানির গুটি একটি সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক একটি ক্ষুদ্র মাইট বা পরজীবীর কারণে হয়। এটি সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে বা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়। মূল লক্ষণ হলো প্রচণ্ড চুলকানি, বিশেষ করে রাতে। এই রোগে ত্বকে গুটি, ফুসকুড়ি, র্যাশ ও লালচে দাগ দেখা যায়। স্ক্যাবিস চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু লোশন ব্যবহার করা হয়। আমরা এই ব্লগে স্ক্যাবিসের লোশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব—কীভাবে এটি কাজ করে, কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সতর্কতা এবং ঘরোয়া প্রতিকারসহ সকল তথ্য জানাবো।
স্ক্যাবিস কি এবং কেন হয়?
স্ক্যাবিস একটি ছোঁয়াচে ত্বকের রোগ, যেখানে একটি মাইট (Sarcoptes scabiei) ত্বকের নিচে গর্ত করে ডিম পাড়ে। এদের বর্জ্য ও ডিমের প্রতিক্রিয়ায় শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া দেখায়, যার ফলে চুলকানি হয়।
স্ক্যাবিসের প্রধান লক্ষণগুলো:
✅ প্রচণ্ড চুলকানি, বিশেষ করে রাতে
✅ ত্বকে গুটি বা ছোট ছোট ফুসকুড়ি
✅ আঙুলের ফাঁক, কবজি, কনুই, নাভির চারপাশে বেশি দেখা যায়
✅ শিশুদের ক্ষেত্রে মাথা, মুখ ও হাত-পায়ে ও হতে পারে
✅ স্ক্র্যাচ করলে সংক্রমণ ও পুঁজ হতে পারে
স্ক্যাবিসের লোশন কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে?
স্ক্যাবিসের লোশন হলো একটি মেডিকেটেড ক্রিম বা লোশন যা সরাসরি ত্বকে প্রয়োগ করে মাইট ও তার ডিম ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত পারমেথ্রিন, বেনজাইল বেনজোয়েট বা সালফার জাতীয় উপাদান দিয়ে তৈরি।
সবচেয়ে কার্যকর স্ক্যাবিস লোশন:
- পারমেথ্রিন লোশন (5%) – সবচেয়ে আধুনিক ও নিরাপদ চিকিৎসা।
- বেনজাইল বেনজোয়েট লোশন (10-25%) – দ্রুত কাজ করে কিন্তু ত্বকে জ্বালাপোড়া করতে পারে।
- সালফার অয়েন্টমেন্ট (5-10%) – শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য নিরাপদ।
- ক্রোটামাইটন লোশন – চুলকানি কমাতে সাহায্য করে।
স্ক্যাবিস কেন হয়?
স্ক্যাবিস মূলত Sarcoptes scabiei মাইটের সংক্রমণের কারণে হয়। এটি ছড়ায়:
- সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে (যেমন: হাত ধরা, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক)
- সংক্রমিত ব্যক্তির বিছানা, তোয়ালে বা কাপড় ব্যবহার করে
- অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস করলে
- দুর্বল ইমিউন সিস্টেম থাকলে (যেমন: HIV, ক্যান্সার রোগী)
স্ক্যাবিস পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় না, কারণ পশুর মাইট মানুষের ত্বকে বেশি দিন বাঁচে না।
স্ক্যাবিস এর লোশন গুলো হলো :
স্ক্যাবিস নিরাময়ে মুখ্য চিকিৎসা হলো স্ক্যাবিস-নাশক লোশন ব্যবহার করা। এই লোশনগুলো মাইট ও এর ডিম ধ্বংস করে এবং নতুন সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
বাজারে প্রচলিত কিছু স্ক্যাবিস লোশন:
লোশনের নাম | সক্রিয় উপাদান | কাজের ধরন | সাধারণ দাম (বাংলাদেশ) |
পারমেথ্রিন ৫% | Permethrin | মাইট ও ডিম ধ্বংস করে | ৳৪০-৭০ (টিউব বা বোতলভেদে) |
লিন্ডেন ১% | Lindane | মাইটকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে মেরে ফেলে | ৳৫০-৮০ |
বেনজিল বেনজোয়েট | Benzyl Benzoate | মাইটের কার্যক্ষমতা বন্ধ করে দেয় | ৳২০-৬০ |
ইভারমেক্টিন (মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট) | Ivermectin | মাইটকে ধ্বংস করে, গুরুতর স্ক্যাবিসে ব্যবহৃত | ৳১০-২৫ (১ ট্যাবলেট) |
স্ক্যাবিস নিরাময়ে লোশনের ভূমিকা:
পারমেথ্রিন ৫% লোশন – সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নিরাপদ
Permethrin 5% cream or lotion স্ক্যাবিস চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কারণ এটি কার্যকর, নিরাপদ এবং শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায় (চিকিৎসকের পরামর্শে)।
ব্যবহারবিধি:
- গোসল করে পরিষ্কার ত্বকে শুকিয়ে নিন।
- মাথা থেকে পা পর্যন্ত (বিশেষ করে আঙুলের ফাঁক, কনুই, নাভির চারপাশ) লোশন লাগান।
- ৮-১৪ ঘণ্টা (সাধারণত রাতভর) রেখে দিন।
- পরের দিন সকালবেলা ভালোভাবে সাবান দিয়ে গোসল করুন।
- ৭ দিন পর আবার একই পদ্ধতিতে পুনরায় প্রয়োগ করুন।
নোট: শুধুমাত্র মুখে, চোখে বা কাটা জায়গায় লাগাবেন না।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- হালকা জ্বালা বা পোড়া অনুভব
- সামান্য চুলকানি
- খুব কম ক্ষেত্রে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন
লিন্ডেন লোশন – সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার
Lindane Lotion আগের সময়ে বেশি ব্যবহার হলেও বর্তমানে কিছু দেশে এর ব্যবহার কমে এসেছে কারণ এটি স্নায়ুতন্ত্রে বিষক্রিয়ার আশঙ্কা বাড়াতে পারে।
কাদের জন্য নয়:
- শিশু
- গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী নারী
- মাথাব্যথা বা খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত রোগী
ব্যবহারবিধি:
- শুষ্ক ত্বকে লাগিয়ে ৮ ঘণ্টা রেখে গোসল করতে হয়।
- মুখ, চোখ, কাটা অংশে লাগানো একেবারেই বারণ।
বেনজিল বেনজোয়েট – সাশ্রয়ী ও কার্যকর
Benzyl Benzoate স্ক্যাবিসের মাইট ধ্বংসে কার্যকর হলেও এটি ব্যবহার করলে হালকা পোড়া বা জ্বালাভাব হতে পারে, বিশেষ করে সংবেদনশীল ত্বকে।
ব্যবহারবিধি:
- ৩ গুণ পানি দিয়ে পাতলা করে ত্বকে লাগাতে হয় (বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে)।
- প্রতিদিন ২-৩ বার ২-৩ দিন লাগাতে হয়।
- চুলকানি বন্ধ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পুনরায় ব্যবহার।
স্ক্যাবিসের লোশন কিভাবে ব্যবহার করবেন?
সঠিক নিয়মে লোশন ব্যবহার না করলে স্ক্যাবিস সম্পূর্ণ সেরে উঠবে না। নিচে ধাপে ধাপে ব্যবহারবিধি দেওয়া হলো:
১. প্রস্তুতি:
- গোসল করে ত্বক পরিষ্কার ও শুকনো করুন।
- সমস্ত শরীরে (গলা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত) লোশন লাগান।
- মুখ ও চোখ এড়িয়ে চলুন (শিশুদের ক্ষেত্রে মাথার তালুও লাগাতে হবে)।
২. প্রয়োগ পদ্ধতি:
- হাতের তালুতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ লোশন নিন।
- পুরো শরীরে সমানভাবে মালিশ করুন (বিশেষ করে আঙুলের ফাঁক, নাভি, যৌনাঙ্গ ও নিতম্বে)।
- ৮-১২ ঘন্টা শরীরে রেখে দিন (রাতে লাগিয়ে সকালে ধুয়ে ফেলুন)।
৩. চিকিৎসার সময়সীমা:
- সাধারণত ৭ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়।
- পরিবারের সবাইকে একসাথে চিকিৎসা নিতে হবে (যেহেতু স্ক্যাবিস ছোঁয়াচে)।
স্ক্যাবিস লোশন ব্যবহারের সতর্কতা:
- গর্ভবতী ও শিশুদের জন্য সালফার বা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী লোশন ব্যবহার করুন।
- অ্যালার্জি টেস্ট করুন (হাতে অল্প পরিমাণে লাগিয়ে দেখুন কোনো র্যাশ হয় কিনা)।
- চোখ, নাক ও মুখে লোশন লাগাবেন না।
- আঁটসাঁট পোশাক পরিধান করুন যাতে লোশন ঘষে না যায়।
স্ক্যাবিসের ঘরোয়া চিকিৎসা:
যদিও লোশন সবচেয়ে কার্যকর, কিছু ঘরোয়া উপায়ে চুলকানি ও সংক্রমণ কমাতে পারেন:
১. নিমের তেল:
- অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক গুণ আছে।
- তেল তুলায় লাগিয়ে আক্রান্ত স্থানে দিনে ২ বার প্রয়োগ করুন।
২. টি ট্রি অয়েল:
- ২-৩ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল নারকেল তেলে মিশিয়ে লাগান।
৩. হলুদ ও নিমপাতা:
- পেস্ট বানিয়ে ক্ষতস্থানে লাগালে চুলকানি কমে।
স্ক্যাবিস প্রতিরোধে করণীয়:
স্ক্যাবিসের চিকিৎসার পাশাপাশি এর পুনরাবৃত্তি রোধ করাও জরুরি।
✅ সবার একসঙ্গে চিকিৎসা করুন: পরিবারের সব সদস্য একইসঙ্গে লোশন ব্যবহার করুন, এমনকি যারা সংক্রমিত না তাদেরও।
✅ জিনিসপত্র পরিষ্কার করুন: বিছানার চাদর, বালিশের কাভার, জামাকাপড় গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকান।
✅ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আলাদা রাখুন: তোয়ালে, পোশাক বা চিরুনি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
✅ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন: নিয়মিত গোসল করুন, পোশাক বদলান, বাড়িঘর পরিষ্কার রাখুন।
চিকিৎসা নেওয়ার সময় ও ভুলগুলো:
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
- ৭-১০ দিন পরেও চুলকানি না কমলে
- র্যাশ বা গুটি বেড়ে গেলে
- ত্বকে ইনফেকশন হলে (পুঁজ বা জ্বর)
- শিশুর ক্ষেত্রে স্ক্যাল্প বা মুখে স্ক্যাবিস হলে
সাধারণ ভুল:
❌ শুধুমাত্র আক্রান্ত স্থানে লোশন লাগানো
❌ রাতের আগে ধুয়ে ফেলা
❌ পরিবারের অন্যদের চিকিৎসা না করানো
❌ পোশাক বা বিছানা না ধোয়া
❌ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বারবার লোশন লাগানো
শিশু ও গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে করণীয়:
শিশুদের জন্য:
- পারমেথ্রিন ৫% লোশনই সবচেয়ে নিরাপদ।
- মুখ, মাথা, কানের পেছনেও লাগাতে হয় (চিকিৎসকের নির্দেশে)।
- লোশন পাতলা করে হালকাভাবে লাগান।
গর্ভবতীদের জন্য:
- পারমেথ্রিন ৫% লোশন চিকিৎসকের অনুমোদনে ব্যবহার করা যায়।
লিন্ডেন সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলুন।
সচরাচর কিছু প্রশ্ন (FAQ):
১. স্ক্যাবিসের লোশন কতদিন লাগে?
সাধারণত ৭-১৪ দিন লাগে, তবে সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য ২ ডোজ প্রয়োজন।
২. স্ক্যাবিস আবার হতে পারে কি?
হ্যাঁ, যদি পরিবারের অন্য কেউ সংক্রমিত থাকে বা চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকে।
৩. পারমেথ্রিন vs বেনজাইল বেনজোয়েট — কোনটি ভালো?
পারমেথ্রিন বেশি নিরাপদ ও কার্যকর, তবে বেনজাইল বেনজোয়েট দ্রুত কাজ করে (তবে জ্বালাপোড়া করতে পারে)।
উপসংহার:
স্ক্যাবিস একটি খুবই সাধারণ এবং চিকিৎসাযোগ্য চর্মরোগ, তবে সচেতনতা, সঠিক লোশন নির্বাচন, সঠিকভাবে প্রয়োগ ও পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে এটি আবার ফিরে আসতে পারে। তাই নিজে যত্ন নিন এবং পরিবারকেও সচেতন করুন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো মনে রাখুন:
✔️ পারমেথ্রিন ৫% লোশন প্রথম পছন্দ
✔️ পুরো শরীরে লাগিয়ে রাতভর রেখে সকালে গোসল
✔️ পরিবারের সবাইকে একসাথে চিকিৎসা করুন
✔️ পোশাক, বিছানা গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকান
✔️ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য লোশন ব্যবহার করবেন না
চিকিৎসকের পরামর্শ
এই ব্লগটি সাধারণ তথ্যভিত্তিক। কারো স্ক্যাবিসের লক্ষণ থাকলে অবশ্যই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। ভুল চিকিৎসা করলে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যায় পরিণত হতে পারে।
দ্রুত চিকিৎসা নিন, সুস্থ থাকুন!