স্ক্যাবিস থেকে মুক্তির উপায়

স্ক্যাবিস থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে জানবো:

স্ক্যাবিস (Scabies) একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ যা “সারকোপটিস স্ক্যাবেই” (Sarcoptes scabiei) নামক ক্ষুদ্র পরজীবী মাইটের কারণে হয়। এই মাইট গুলি ত্বকে গর্ত করে এবং ডিম পাড়ে, যার ফলে ত্বকে প্রচণ্ড চুলকানি, ফুসকুড়ি ও অস্বস্তি দেখা যায়। এটি পরিবারের একজন সদস্য থেকে অন্যদের মধ্যেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই স্ক্যাবিস হলে দ্রুত চিকিৎসা ও সতর্কতা জরুরি।

স্ক্যাবিস কি এবং কিভাবে ছড়ায়?

স্ক্যাবিস হল এক ধরনের ছোঁয়াচে চর্মরোগ, যেখানে ছোট একধরনের পরজীবী মাইট ত্বকে বাসা বাঁধে। এই পরজীবীগুলি ত্বকে ছোট গর্ত করে সেখানে ডিম পাড়ে। সাধারণত ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে এটি একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়।

এটি সাধারণত:

  • হাতের আঙুলের ফাঁকে
  • কবজিতে
  • কনুইতে
  • বগলে
  • যৌনাঙ্গে
  • কোমরে
    প্রভাব ফেলে।

স্ক্যাবিস দ্রুত সংক্রমিত হয়, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে বা যেখানে মানুষের মধ্যে শারীরিক সংস্পর্শ বেশি (যেমন: পরিবার, হোস্টেল, ডে-কেয়ার সেন্টার ইত্যাদি)।

ছড়ানোর উপায়:

  • আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে থাকা

  • একই বিছানা, কাপড় বা তোয়ালে ব্যবহার করা

  • শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার সময় সংস্পর্শ

স্ক্যাবিসের লক্ষণ:

স্ক্যাবিস সংক্রমণের লক্ষণগুলো সাধারণত ৪-৬ সপ্তাহ পরে দেখা দেয় (যদি প্রথমবার সংক্রমিত হয়)। তবে যারা আগে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা দিতে পারে।

প্রধান লক্ষণগুলো:

  1. তীব্র চুলকানি (বিশেষ করে রাতের বেলা)
  2. লাল ফুসকুড়ি বা দাগ (ছোট ছোট গোটা বা ফোস্কার মতো)
  3. সূক্ষ্ম ধূসর বা লাল রেখা (মাইটের গর্তের চিহ্ন)
  4. খোসা উঠা বা ঘা (অতিরিক্ত চুলকালে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়)
  5. সংক্রমণের বিস্তার (প্রাথমিকভাবে হাত ও আঙুলে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়ায়)

স্ক্যাবিসের একটি বিশেষ ধরন হলো ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস (Norwegian Scabies), যা খুবই গুরুতর এবং দ্রুত ছড়ায়। এটি সাধারণত দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।

স্ক্যাবিস কেন হয়?

স্ক্যাবিস মূলত Sarcoptes scabiei মাইটের সংক্রমণের কারণে হয়। এটি ছড়ায়:

  1. সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে (যেমন: হাত ধরা, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক)
  2. সংক্রমিত ব্যক্তির বিছানা, তোয়ালে বা কাপড় ব্যবহার করে
  3. অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস করলে
  4. দুর্বল ইমিউন সিস্টেম থাকলে (যেমন: HIV, ক্যান্সার রোগী)

স্ক্যাবিস পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় না, কারণ পশুর মাইট মানুষের ত্বকে বেশি দিন বাঁচে না।

স্ক্যাবিস এ কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন?

  • যাদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কম

  • যারা ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে থাকেন (পরিবার, হোস্টেল)

  • শিশু ও বৃদ্ধ ব্যক্তি

  • স্বাস্থ্যকর্মী বা নার্সিং স্টাফ

স্ক্যাবিস থেকে মুক্তির উপায় ও চিকিৎসা:

স্ক্যাবিস চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। সাধারণত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিচের ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়:

১. পারমেথ্রিন (Permethrin) ৫% ক্রিম

  • এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ঔষধ।

     

  • সমস্ত শরীরে (গলা থেকে পা পর্যন্ত) ব্যবহার করতে হয়, বিশেষ করে আক্রান্ত স্থানে।

     

  • রাতে লাগিয়ে ৮-১২ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলতে হয়।

     

  • এক সপ্তাহ পর আবার লাগানো যেতে পারে।

     

২. বেনজাইল বেনজোয়েট (Benzyl Benzoate)

  • কিছুটা জ্বালাপোড়া হতে পারে, তাই শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্কতা দরকার।

     

৩. ইভারমেকটিন (Ivermectin) ট্যাবলেট

  • কিছু ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

     

  • গর্ভবতী মহিলা ও ১৫ কেজির কম ওজনের শিশুদের ক্ষেত্রে এড়ানো উচিত।

     

৪. অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট

  • চুলকানি কমাতে ব্যবহৃত হয় (যেমন ফেক্সোফেনাডিন, সিটিরিজিন ইত্যাদি)।

     

চিকিৎসার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:

  • পরিবারের সব সদস্যকে একসাথে চিকিৎসা করানো জরুরি

     

  • ব্যবহৃত কাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে সব গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে

     

ওষুধ লাগানোর আগে ভালো করে গোসল করা উচিত

স্ক্যাবিস এর ঘরোয়া প্রতিকার:

চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া উপায় স্ক্যাবিস থেকে দ্রুত আরাম পেতে সাহায্য করতে পারে। তবে এগুলো শুধুমাত্র সহায়ক, প্রধান চিকিৎসার বিকল্প নয়।

১. নিমপাতা

  • নিমের পাতা চুলকানির উপশমে দারুণ কার্যকর।

  • নিমপাতা সেদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে গোসল করা যেতে পারে।

  • নিম তেলও আক্রান্ত স্থানে লাগানো যেতে পারে।

২. নারকেল তেল ও কর্পূর

  • সামান্য কর্পূর নারকেল তেলে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগালে আরাম পাওয়া যায়।

৩. লবণ পানির গোসল

  • সমুদ্রের লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বক পরিষ্কার থাকে ও চুলকানি কমে।

৪. বেকিং সোডা ও পানি

বেকিং সোডা ও সামান্য পানি মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগালে চুলকানি কিছুটা কমে যায়।

স্ক্যাবিস প্রতিরোধের উপায়:

স্ক্যাবিস প্রতিরোধে সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক পরামর্শ দেওয়া হলো:

  1. ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন

     

  2. সপ্তাহে অন্তত ২-৩ বার গোসল করুন

     

  3. নিজের তোয়ালে, চাদর, জামা- কাপড় অন্য কারো সাথে ভাগ করে ব্যবহার করবেন না

     

  4. আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি না আসা

     

  5. ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন

     

  6. শিশুদের নখ ছোট করে কেটে পরিষ্কার রাখুন

     

  7. আক্রান্ত ব্যক্তির কাপড় ও বিছানার চাদর গরম পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকান

চিকিৎসা না করলে কী সমস্যা হতে পারে?

স্ক্যাবিস চিকিৎসা না করলে ত্বকের ওপর আরও বেশি গর্ত ও ক্ষত তৈরি হয় এবং এতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও দেখা দিতে পারে। ফলে তৈরি হতে পারে:

  • সেকেন্ডারি ইনফেকশন (যেমন ইম্পেটিগো)

  • ফুসকুড়ি থেকে পুঁজ হওয়া

  • ঘুমে সমস্যা

  • পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আক্রান্ত হওয়া

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন:

শিশুদের ক্ষেত্রে স্ক্যাবিস দ্রুত ছড়ায় ও সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। তাই:

  • তাদের জামা-কাপড় প্রতিদিন বদলানো

  • নখ ছোট করে কাটা

  • চুলকানোর পরও যাতে সংক্রমণ না হয়, সে জন্য ত্বক পরিষ্কার রাখা

  • পেডিয়াট্রিশিয়ান বা শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করা

গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা:

গর্ভাবস্থায় সব ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিছুই ব্যবহার করা উচিত নয়। সাধারণত পারমেথ্রিন ক্রিম নিরাপদ ধরা হয়, তবে তা ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের অনুমোদন আবশ্যক।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

  • ওষুধ ব্যবহারের পরও ২ সপ্তাহের বেশি চুলকানি থাকলে

  • ফুসকুড়ি থেকে পুঁজ বা রক্ত বের হলে

  • শিশুরা রাতে ঘুমাতে না পারলে

  • গর্ভবতী বা বুকের দুধ খাওয়ান এমন মা আক্রান্ত হলে

স্ক্যাবিস নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা:

  1. স্ক্যাবিস শুধু অপরিচ্ছন্ন লোকের হয় ❌
    • সত্য: যেকোনো স্বচ্ছল ব্যক্তিও স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হতে পারেন।
  2. স্ক্যাবিস পানি থেকে ছড়ায় ❌
    • সত্য: এটি শুধু ত্বকের সংস্পর্শে ছড়ায়।
  3. স্ক্যাবিস একবার হলে বারবার হবে ❌
    • সত্য: সঠিক চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণ সেরে যায়।

উপসংহার:

স্ক্যাবিস কোনো গুরুতর রোগ না হলেও তা অস্বস্তিকর এবং খুব সহজেই ছড়াতে পারে। তাই লক্ষণ দেখা মাত্রই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা উচিত। পরিবারের সবাইকে একসাথে চিকিৎসা করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, এবং কিছু ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করলে স্ক্যাবিস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো – নিজের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা। এতে করে শুধু নিজের নয়, প্রিয়জনদেরও সুস্থ রাখা সম্ভব।

বি.দ্র: উপরের সব তথ্য সাধারণ জ্ঞান ও চিকিৎসা ভিত্তিক পরামর্শ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কারও যদি জটিলতা বা অ্যালার্জির সমস্যা থাকে, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা নিতে হবে।

Scroll to Top