
স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম কি কি?
স্ক্যাবিস একটি সংক্রামক চর্মরোগ যা ‘সারকপটিস স্ক্যাবেই’ (Sarcoptes scabiei) নামক ক্ষুদ্র আকারের পরজীবী (mites) দ্বারা হয়। এই পোকাটি ত্বকের নিচে ঢুকে যায় এবং সেখানে ডিম পাড়ে, যার ফলে তীব্র চুলকানি ও ত্বকে র্যাশ দেখা যায়। স্ক্যাবিস শিশু-বৃদ্ধ সকল বয়সের মানুষের মধ্যে হতে পারে এবং এটি খুব সহজেই একজনের থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রোগের চিকিৎসা সাধারণত বিশেষ ধরনের ওষুধ দিয়ে করা হয়, যেগুলো চর্মের উপর লাগানো হয় বা কখনো কখনো খাওয়া হয়। আমরা এই ব্লগে সহজ ভাষায় জানবো স্ক্যাবিস রোগের প্রধান ঔষধের নাম, কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এবং ঘরোয়া কিছু যত্ন।
স্ক্যাবিস রোগের কারণ ও লক্ষণ:
স্ক্যাবিস কিভাবে হয়?
স্ক্যাবিস রোগ হয় সারকোপটেস স্ক্যাবি নামক এক ধরনের ক্ষুদ্র পরজীবীর কারণে। এই মাইট ত্বকের নিচে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং ডিম পাড়ে, যার ফলে তীব্র চুলকানি ও ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এটি সাধারণত:
- সরাসরি সংস্পর্শে (যেমন: একই বিছানায় শোয়া, হাত ধরা)
- আক্রান্ত ব্যক্তির কাপড়, তোয়ালে বা বিছানা ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়ায়।
স্ক্যাবিসের প্রধান লক্ষণ:
- তীব্র চুলকানি (বিশেষ করে রাতে বেশি হয়)
- ত্বকে লাল গুটি বা ফুসকুড়ি
- আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে চুলকানি
- কনুই, কনকাপ, কোমর, বগল, গোপনাঙ্গের আশেপাশে গুটি বা ফুসকুড়ি
- শিশুদের ক্ষেত্রে মুখ, মাথা ও হাত-পায়ে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে
চুলকানি শুরু হওয়ার প্রায় ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর লক্ষণ প্রকট হয়। তবে পূর্বে আক্রান্ত কেউ পুনরায় সংক্রমিত হলে ১–৪ দিনের মধ্যেই লক্ষণ দেখা দেয়।
স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম ও ব্যবহারবিধি:
এখন আমরা স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সবচেয়ে কার্যকর ওষুধগুলোর তালিকা দিচ্ছি।
১. পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম (Permethrin 5% Cream)
✅ বাজারে পরিচিত নাম:
- Permite Cream
- Scabper
- Elimite
- Permiskin
✅ ব্যবহার:
- পুরো শরীরে (গলা থেকে নিচে পর্যন্ত) একবার লাগাতে হবে।
- রাতে ঘুমানোর আগে লাগানো উচিত এবং পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলতে হয়।
- শিশুদের ক্ষেত্রে মাথা, মুখ ও কানের পিছনেও লাগাতে হয়।
✅ কার্যকারিতা:
- এটি স্ক্যাবিসের কারণ ‘সারকপটিস স্ক্যাবেই’ কে মেরে ফেলে।
- সাধারণত ১ বার ব্যবহারে রোগ সেরে যায়, তবে প্রয়োজনে ৭ দিন পর আবার ব্যবহার করা যেতে পারে।
✅ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- হালকা জ্বালাপোড়া
- ত্বকে সামান্য লালচে ভাব
- চুলকানি কিছুদিন থেকে যেতে পারে
২. আইভারমেকটিন ট্যাবলেট (Ivermectin Tablet)
✅ বাজারে পরিচিত নাম:
- Iverjohn
- Ivemek
- Scavista
- Ivertop
✅ ব্যবহার:
- এটি মুখে খাওয়ার ঔষধ।
- সাধারণত ২০০ মাইক্রোগ্রাম/কেজি ওজন অনুযায়ী ডোজ নির্ধারণ হয়।
- একবার খাওয়ার ৭ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়।
✅ কার্যকারিতা:
- শরীরের ভিতরে গিয়ে এই ওষুধ পোকা মেরে ফেলে।
- গুরুতর বা ব্যর্থ স্ক্যাবিস রোগে কার্যকর।
✅ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- মাথাব্যথা
- মাথা ঘোরা
- হালকা জ্বর
- ত্বকে অ্যালার্জির মতো র্যাশ
🔴 গর্ভবতী নারী ও ১৫ কেজির কম ওজনের শিশুদের জন্য এ ওষুধ নিষেধ।
৩. সালফার অয়েন্টমেন্ট (Sulfur Ointment, 5%-10%)
✅ বাজারে পরিচিত নাম:
- Sulphur Cream
- Scabex-S
- Scaboma Sulfur
✅ ব্যবহার:
- সাধারণত ৩-৬ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে পুরো শরীরে লাগাতে হয়।
- সকালে ধুয়ে ফেলতে হয়।
✅ কার্যকারিতা:
- এটি প্রাচীন এবং নিরাপদ পদ্ধতি, বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য।
✅ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- গন্ধ কিছুটা তীব্র হতে পারে
- ত্বক শুষ্ক বা খসখসে হতে পারে
৪. বেনজাইল বেনজোয়েট লোশন (Benzyl Benzoate Lotion, 25%)
✅ বাজারে পরিচিত নাম:
- Ascabiol
- Scabind
- Scabisil
✅ ব্যবহার:
- ২-৩ দিন ধরে পুরো শরীরে ঘষে ঘষে লাগাতে হয়
- ২৪ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলতে হয়
✅ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- জ্বালাপোড়া হতে পারে, বিশেষ করে সংবেদনশীল ত্বকে
- শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হয়
৫. ক্রোটামিটন লোশন বা ক্রিম (Crotamiton Lotion/Cream 10%)
✅ বাজারে পরিচিত নাম:
- Eurax
- Itchinil
- Crotorax
✅ ব্যবহার:
- দিনে ১-২ বার করে ৫ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়
- এটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য
✅ কার্যকারিতা:
- স্ক্যাবিসের পোকা ধ্বংস করে
চুলকানি প্রশমিত করে
স্ক্যাবিস রোগের বিশেষ যত্ন ও পরামর্শ:
১. জামা-কাপড় ও বিছানার চাদর পরিষ্কার করুন
স্ক্যাবিসের পোকা জামাকাপড় বা বিছানাতেও থাকতে পারে, তাই ব্যবহার করা সমস্ত কাপড়, তোয়ালে ও বিছানার চাদর গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে।
২. পরিবারের সবাইকে একসাথে চিকিৎসা করুন
স্ক্যাবিস ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় পরিবারের প্রত্যেককে একসাথে চিকিৎসা করা উচিত, না হলে বারবার পুনরায় সংক্রমণ হতে পারে।
৩. চিকিৎসা শেষে চুলকানি কয়েকদিন থাকতে পারে
চিকিৎসার পর চুলকানি কয়েকদিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এটি ‘post-scabies itch’ নামে পরিচিত। তবে এটি মানেই যে রোগ সারেনি—চিকিৎসক বুঝে এন্টিহিস্টামিন (চুলকানি কমানোর ওষুধ) দিতে পারেন।
৪. স্ক্যাবিস প্রতিরোধে করণীয়
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
- আক্রান্ত ব্যক্তির জামা-কাপড়, তোয়ালে, বিছানার চাদর ব্যবহার না করা
- বাসা ও ঘরের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা
স্ক্যাবিসের ঘরোয়া প্রতিকার:
যদি ঔষধ না পাওয়া যায়, তাহলে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি চুলকানি কমাতে সাহায্য করতে পারে:
১. নিম পাতা
- নিমের অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক গুণ মাইট দমনে সাহায্য করে।
- কিভাবে ব্যবহার করবেন?
- নিম পাতা পেস্ট করে আক্রান্ত স্থানে লাগান।
- নিমের তেল জলে মিশিয়ে গোসল করুন।
২. টি ট্রি অয়েল
- প্রাকৃতিক অ্যান্টি-মাইট এজেন্ট।
- কিভাবে ব্যবহার করবেন?
- ১ চামচ নারিকেল তেল + ৫-১০ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল মিশিয়ে লাগান।
৩. লেবু ও হলুদ
- হলুদের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ স্ক্যাবিসের চুলকানি কমায়।
- কিভাবে ব্যবহার করবেন?
- হলুদ ও লেবুর রস মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে লাগান।
চিকিৎসকের কাছে কখন যাবেন?
- চিকিৎসার ২ সপ্তাহ পরেও উপসর্গ না কমলে
- শরীরে পুঁজযুক্ত ফুসকুড়ি দেখা দিলে
- জ্বর বা অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করলে
- শিশু বা গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি
সচরাচর কিছু প্রশ্ন (FAQ):
Q: স্ক্যাবিস কি নিজে নিজে সেরে যায়?
A: না, স্ক্যাবিস নিজে থেকে সেরে যায় না। ঔষধ দিয়ে মাইট মারা প্রয়োজন।
Q: স্ক্যাবিসের চুলকানি কতদিন থাকে?
A: চিকিৎসার পরও ২-৪ সপ্তাহ চুলকানি থাকতে পারে (অ্যালার্জি রিঅ্যাকশনের কারণে)।
Q: পারমেথ্রিন ক্রিম কোথায় পাব?
A: যেকোনো ফার্মেসিতে পাওয়া যায় (ব্র্যান্ড: Scaboma, Permite)।
Q: স্ক্যাবিস কি পুনরায় হতে পারে?
A: হ্যাঁ, যদি পরিবারের সবাই চিকিৎসা না নেয় বা কাপড়-চোপড় ঠিকভাবে ধোয়া না হয়।
উপসংহার:
স্ক্যাবিস একটি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত বিরক্তিকর চর্মরোগ। সঠিক ঔষধ ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এটি সহজেই ভালো হয়ে যায়। তবে চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজে কোনো ওষুধ শুরু না করে, উপসর্গ বুঝে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সুস্থ থাকতে চাইলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হোন, নিজের যত্ন নিন, এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সহায়তা নিন।