হেপাটাইটিস

হেপাটাইটিস কি?

হেপাটাইটিস হলো একটি লিভারের প্রদাহজনিত রোগ, যা মূলত বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন ভাইরাস, অ্যালকোহল, ড্রাগ বা অন্যান্য অসুস্থতার কারণে। লিভার শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা খাবার থেকে পুষ্টি শোষণ, বিষাক্ত পদার্থ থেকে মুক্তি, ভিটামিন এবং খনিজ মেটাবলিজমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লিভারের স্বাস্থ্য আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হেপাটাইটিসের কারণে লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে লিভারের সিরোসিস বা ক্যান্সারের দিকে যেতে পারে।

হেপাটাইটিসের কারণে পুরো শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এটি যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হয়, তবে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস সবচেয়ে সাধারণ এবং এটি কিছু নির্দিষ্ট প্রকারে ভাগ করা হয়। 

হেপাটাইটিসের প্রকারভেদ: কে কত বিপজ্জনক?

হেপাটাইটিস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকার হলো:

১. হেপাটাইটিস এ (Hepatitis A):

  • কারণ: হেপাটাইটিস এ ভাইরাস (HAV) দ্বারা সৃষ্ট।
  • সংক্রমণ: এটি সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির মলের মাধ্যমে ভাইরাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। অপরিষ্কার হাত দিয়ে খাবার খেলে বা দূষিত পানি পান করলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • লক্ষণ: সাধারণত হালকা হয়। জ্বর, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, জন্ডিস (চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া), গাঢ় প্রস্রাব এবং হালকা রঙের মল হতে পারে।
  • চিকিৎসা: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত তরল পান করা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত পুরোপুরি সেরে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদী কোনো ক্ষতি হয় না।
  • প্রতিরোধ: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, খাবার ও পানি ফুটিয়ে খাওয়া, এবং হেপাটাইটিস এ-এর টিকা গ্রহণ করা এর প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

২. হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B):

  • কারণ: হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (HBV) দ্বারা সৃষ্ট।
  • সংক্রমণ: এটি রক্ত, বীর্য এবং শরীরের অন্যান্য তরল পদার্থের মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে শিশুর জন্মকালে, অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ, এবং দূষিত রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। সেলুন, ডেন্টাল ক্লিনিক বা হাসপাতালে জীবাণুমুক্ত নয় এমন সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমেও সংক্রমণ হতে পারে।
  • লক্ষণ: তীব্র হেপাটাইটিস বি-এর ক্ষেত্রে জ্বর, ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, গাঢ় প্রস্রাব, হালকা রঙের মল, এবং জন্ডিস হতে পারে। কিছু লোকের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি (Chronic Hepatitis B) হলে লিভারের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়, যা থেকে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হতে পারে।
  • চিকিৎসা: তীব্র হেপাটাইটিস বি-এর ক্ষেত্রে সাধারণত বিশ্রাম এবং সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া হয়। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি-এর জন্য অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ ব্যবহার করা হয়, যা ভাইরাসের সংখ্যা কমাতে এবং লিভারের ক্ষতি রোধ করতে সাহায্য করে। তবে সম্পূর্ণ নিরাময় প্রায়শই সম্ভব হয় না।
  • প্রতিরোধ: হেপাটাইটিস বি-এর টিকা গ্রহণ করা সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। নবজাতক থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্যই এই টিকা গুরুত্বপূর্ণ। সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন, ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা, এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্ত গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।

৩. হেপাটাইটিস সি (Hepatitis C):

  • কারণ: হেপাটাইটিস সি ভাইরাস (HCV) দ্বারা সৃষ্ট।
  • সংক্রমণ: এটি মূলত রক্ত ​​থেকে রক্তে সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ায়। ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ, দূষিত রক্ত ​​সঞ্চালন (বিশেষ করে ১৯৯২ সালের আগে), এবং জীবাণুমুক্ত নয় এমন সরঞ্জাম দিয়ে ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করা এর প্রধান কারণ। খুব কম ক্ষেত্রে যৌন মিলনের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
  • লক্ষণ: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তীব্র হেপাটাইটিস সি-এর কোনো লক্ষণ থাকে না। এটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে কোনো লক্ষণ অনুভব করেন না। তবে, দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস সি (Chronic Hepatitis C) হলে লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যা থেকে লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিওর বা লিভার ক্যান্সার হতে পারে।
  • চিকিৎসা: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হেপাটাইটিস সি-এর চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। নতুন অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ (DAAs – Direct-Acting Antivirals) ব্যবহার করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। চিকিৎসার সময়কাল সাধারণত ৮-১২ সপ্তাহ হয়।
  • প্রতিরোধ: হেপাটাইটিস সি-এর কোনো টিকা নেই। তাই প্রতিরোধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এড়িয়ে চলা জরুরি। ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা, দূষিত রক্ত ​​এড়িয়ে চলা, এবং ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করার সময় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জামের ব্যবহার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

৪. হেপাটাইটিস ডি (Hepatitis D):

  • কারণ: হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস (HDV) দ্বারা সৃষ্ট। এটি একটি “অসম্পূর্ণ” ভাইরাস, যা কেবল তখনই সংক্রমণ ঘটাতে পারে যখন হেপাটাইটিস বি ভাইরাসও উপস্থিত থাকে। অর্থাৎ, হেপাটাইটিস বি ছাড়া হেপাটাইটিস ডি হতে পারে না।
  • সংক্রমণ: হেপাটাইটিস বি-এর মতোই রক্ত ​​এবং শরীরের অন্যান্য তরল পদার্থের মাধ্যমে ছড়ায়।
  • লক্ষণ: হেপাটাইটিস বি-এর সাথে হেপাটাইটিস ডি থাকলে রোগের তীব্রতা বেশি হয় এবং লিভারের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। এটি দ্রুত লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
  • চিকিৎসা: হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসার সাথে সাথে হেপাটাইটিস ডি-এর জন্য কিছু নতুন ঔষধের গবেষণা চলছে।
  • প্রতিরোধ: হেপাটাইটিস বি-এর টিকা গ্রহণ করা হেপাটাইটিস ডি প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। কারণ হেপাটাইটিস বি না হলে হেপাটাইটিস ডি হতে পারে না।

৫. হেপাটাইটিস ই (Hepatitis E):

  • কারণ: হেপাটাইটিস ই ভাইরাস (HEV) দ্বারা সৃষ্ট।
  • সংক্রমণ: হেপাটাইটিস এ-এর মতোই এটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।
  • লক্ষণ: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হালকা হয় এবং নিজে নিজেই সেরে যায়। তবে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে এবং লিভার ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • চিকিৎসা: সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। বিশ্রাম এবং সহায়ক যত্ন গুরুত্বপূর্ণ।
  • প্রতিরোধ: পরিষ্কার পানি পান করা এবং খাবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে তৈরি করা এর প্রতিরোধের প্রধান উপায়। কিছু দেশে হেপাটাইটিস ই-এর টিকা পাওয়া যায়, তবে এটি বিশ্বব্যাপী সহজলভ্য নয়।

অন্যান্য কারণে হেপাটাইটিস:

  • অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস: অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রদাহ হয়। দীর্ঘমেয়াদী অ্যালকোহল সেবন লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
  • অটোইমিউন হেপাটাইটিস: যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে লিভার কোষকে আক্রমণ করে, তখন এই ধরনের হেপাটাইটিস হয়।
  • ড্রাগ-ইনডিউসড হেপাটাইটিস: কিছু নির্দিষ্ট ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

হেপাটাইটিসের সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ:

হেপাটাইটিসের লক্ষণগুলো রোগের ধরণ এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:

  • ক্লান্তি এবং দুর্বলতা: অস্বাভাবিকভাবে ক্লান্ত অনুভব করা।
  • জ্বর: হালকা থেকে মাঝারি জ্বর।
  • পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা: শরীর ব্যথা করা।
  • ক্ষুদামন্দা: খাবার খেতে অনীহা।
  • বমি বমি ভাব বা বমি: বিশেষ করে সকালে।
  • পেটে ব্যথা: বিশেষ করে ডান উপরের পেটে, যেখানে লিভার থাকে।
  • গাঢ় প্রস্রাব: প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ বা বাদামী হওয়া।
  • হালকা রঙের মল: মলের রঙ অস্বাভাবিকভাবে হালকা বা সাদাটে হওয়া।
  • জন্ডিস: চোখ এবং ত্বকের রঙ হলুদ হয়ে যাওয়া। এটি লিভারের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার একটি সুস্পষ্ট লক্ষণ।
  • ত্বকে চুলকানি: জন্ডিসের কারণে ত্বকে চুলকানি হতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনেক সময় হেপাটাইটিসের কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি এবং সি-এর ক্ষেত্রে। এ কারণেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি, বিশেষ করে যারা ঝুঁকিতে আছেন।

রোগ নির্ণয়: কিভাবে হেপাটাইটিস ধরা পড়ে?

হেপাটাইটিস নির্ণয়ের জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করা হয়:

১. রক্ত পরীক্ষা: * লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT): লিভার এনজাইম (ALT, AST) এবং বিলিরুবিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এই মাত্রাগুলো লিভারের ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। * ভাইরাল মার্কার টেস্ট: হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপস্থিতি এবং ভাইরাসের ধরন (A, B, C, D, E) শনাক্ত করার জন্য specific অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয়। যেমন: HBsAg (হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেন), Anti-HCV (হেপাটাইটিস সি অ্যান্টিবডি)। * ভাইরাল লোড টেস্ট: হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের সংখ্যা পরিমাপ করার জন্য (PCR টেস্ট)। এটি চিকিৎসার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণেও সাহায্য করে।

২. ইমেজিং টেস্ট: * আল্ট্রাসাউন্ড: লিভারের আকার, গঠন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা দেখতে সাহায্য করে। * ফাইব্রোস্ক্যান বা ইলাস্টোগ্রাফি: লিভারের কাঠিন্য বা ফাইব্রোসিসের মাত্রা পরিমাপ করে। এটি লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি নির্ণয়ে সাহায্য করে। * সিটি স্ক্যান বা এমআরআই: আরও বিস্তারিত ছবি পাওয়ার জন্য, বিশেষ করে যদি লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারের সন্দেহ হয়।

৩. লিভার বায়োপসি: কিছু ক্ষেত্রে, লিভারের টিস্যুর একটি ছোট নমুনা নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা হয়। এটি লিভারের ক্ষতির মাত্রা এবং রোগের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়। তবে এটি একটি আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়া এবং বর্তমানে ফাইব্রোস্ক্যানের মতো অ-আক্রমণাত্মক পরীক্ষার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

চিকিৎসা: হেপাটাইটিস কি সারে?

হেপাটাইটিসের চিকিৎসা রোগের ধরণ, তীব্রতা এবং লিভারের ক্ষতির উপর নির্ভর করে।

  • হেপাটাইটিস এ এবং ই: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল পান এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করে শরীর নিজে থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে।
  • তীব্র হেপাটাইটিস বি: সাধারণত সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
  • দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি: অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ ব্যবহার করা হয় যা ভাইরাসের সংখ্যা কমাতে এবং লিভারের ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। এই ঔষধগুলো রোগ নিরাময় না করলেও রোগের অগ্রগতি ধীর করতে পারে এবং জটিলতা রোধ করতে পারে। নিয়মিত ফলো-আপ এবং রক্ত পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
  • হেপাটাইটিস সি: হেপাটাইটিস সি-এর চিকিৎসায় নতুন অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ (Direct-Acting Antivirals – DAAs) বিপ্লব এনেছে। এই ঔষধগুলো অত্যন্ত কার্যকর এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। চিকিৎসার সময়কাল সাধারণত ৮-১২ সপ্তাহ হয়। চিকিৎসা চলাকালীন এবং পরবর্তীতে নিয়মিত ফলো-আপ জরুরি।
  • হেপাটাইটিস ডি: হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসার সাথে সাথে হেপাটাইটিস ডি-এর জন্য কিছু নতুন ঔষধের গবেষণা চলছে।
  • অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস: অ্যালকোহল সেবন সম্পূর্ণ বন্ধ করা অপরিহার্য। এর সাথে সহায়ক চিকিৎসা এবং পুষ্টি সহায়তা প্রদান করা হয়।
  • অটোইমিউন হেপাটাইটিস: ইমিউনোসাপ্রেসিভ ঔষধ (যেমন স্টেরয়েড) ব্যবহার করা হয় লিভারের প্রদাহ কমাতে।

যদি লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হয় (যেমন লিভার সিরোসিস বা লিভার ফেইলিওর), তবে কিছু ক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপন (Liver Transplant) একমাত্র সমাধান হতে পারে।

প্রতিরোধ: কিভাবে হেপাটাইটিস থেকে বাঁচবেন?

প্রতিরোধই হেপাটাইটিস মোকাবেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করে আপনি নিজেকে এবং আপনার পরিবারকে এই মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করতে পারেন।

১. টিকা গ্রহণ করুন: * হেপাটাইটিস এ টিকা: দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ করে। ভ্রমণের আগে বা যারা ঝুঁকিতে আছেন তাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। * হেপাটাইটিস বি টিকা: নবজাতক থেকে শুরু করে সবার জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। হেপাটাইটিস বি টিকা হেপাটাইটিস ডি থেকেও সুরক্ষা দেয়। তিনটি ডোজের একটি কোর্স সম্পূর্ণ করা উচিত।

২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন: * খাবার তৈরির আগে এবং পরে, টয়লেট ব্যবহারের পরে সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া। * ফলমূল ও শাকসবজি ভালো করে ধুয়ে খাওয়া। * বিশুদ্ধ পানি পান করা (ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে)।

৩. নিরাপদ যৌন অনুশীলন: * সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করুন। একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন।

৪. সুচ ও সিরিঞ্জের ব্যবহার: * কখনো ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না। মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এটি একটি বড় ঝুঁকি। * ডাক্তারি পরীক্ষা বা রক্ত ​​পরীক্ষার জন্য সবসময় নতুন এবং জীবাণুমুক্ত সুচ ব্যবহার নিশ্চিত করুন।

৫. রক্ত ​​এবং রক্তজাতীয় পণ্যের নিরাপত্তা: * রক্ত ​​সঞ্চালনের আগে অবশ্যই হেপাটাইটিস ভাইরাসের জন্য রক্ত ​​পরীক্ষা করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। আমাদের দেশে এখন রক্ত ​​পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। * অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও একই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

৬. ট্যাটু, পিয়ার্সিং এবং সেলুন: * ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করানোর সময় নিশ্চিত করুন যে সরঞ্জামগুলো জীবাণুমুক্ত এবং পেশাদার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। * দাঁতের ডাক্তার বা সেলুনে ক্ষুর, ব্লেড, কাঁচি ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন। ব্যক্তিগত সামগ্রী (যেমন রেজার, টুথব্রাশ, নেইল ক্লিপার) শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।

৭. অ্যালকোহল পরিহার: * অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন লিভারের মারাত্মক ক্ষতি করে। অ্যালকোহল পরিহার করা লিভার সুস্থ রাখার অন্যতম উপায়।

৮. সচেতনতা বৃদ্ধি: * হেপাটাইটিস সম্পর্কে জানুন এবং অন্যদের সচেতন করুন। সঠিক তথ্যই এই রোগ প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। * যারা ঝুঁকিতে আছেন, তাদের নিয়মিত পরীক্ষা করানো জরুরি।

হেপাটাইটিস নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা ও সঠিক তথ্য:

  • ভুল ধারণা: হেপাটাইটিস মানেই জন্ডিস।

    • সঠিক তথ্য: হেপাটাইটিসের একটি সাধারণ লক্ষণ জন্ডিস হলেও, সব হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে জন্ডিস নাও হতে পারে। বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি এবং সি-এর ক্ষেত্রে জন্ডিস ছাড়াই লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

  • ভুল ধারণা: হেপাটাইটিস একটি বংশগত রোগ।

    • সঠিক তথ্য: হেপাটাইটিস ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ, বংশগত নয়। তবে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে তার নবজাতক শিশুর শরীরে ভাইরাস ছড়াতে পারে।

  • ভুল ধারণা: হেপাটাইটিস রোগীকে ছুঁলে বা তার সাথে একই ঘরে থাকলে রোগ ছড়ায়।

    • সঠিক তথ্য: হেপাটাইটিস এ এবং ই দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়ায়। হেপাটাইটিস বি এবং সি রক্ত ​​বা শরীরের তরল পদার্থের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণ স্পর্শ, একই ঘরে থাকা, একই বাথরুম ব্যবহার করা বা একই প্লেটে খেলে রোগ ছড়ায় না।

  • ভুল ধারণা: একবার হেপাটাইটিস হলে আর নিরাময় হয় না।

সঠিক তথ্য: হেপাটাইটিস এ এবং ই সাধারণত সম্পূর্ণ সেরে যায়। হেপাটাইটিস সি এখন নতুন ঔষধের মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। হেপাটাইটিস বি সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও, ঔষধের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং লিভারের ক্ষতি রোধ করা যায়।

হেপাটাইটিস সম্পর্কে আমাদের করণীয়:

বাংলাদেশ হেপাটাইটিসের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। আমাদের সবার সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

  • টেস্ট করান: আপনি যদি মনে করেন যে আপনি ঝুঁকির মধ্যে আছেন বা আপনার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাহলে হেপাটাইটিস পরীক্ষা করিয়ে নিন। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই হেপাটাইটিস বি এবং সি নির্ণয় করা যায়।
  • টিকা নিন: আপনার এবং আপনার পরিবারের সবার হেপাটাইটিস এ এবং বি-এর টিকা নিশ্চিত করুন। নবজাতকদের হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া আবশ্যক।
  • সচেতন হোন: হেপাটাইটিস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুন এবং আপনার পরিচিতদের মধ্যে ছড়িয়ে দিন।
  • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: সুষম খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং অ্যালকোহল পরিহার করে লিভারকে সুস্থ রাখুন।
  • ডাক্তারের পরামর্শ নিন: যদি আপনার হেপাটাইটিস ধরা পড়ে, তাহলে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং নিয়মিত ফলো-আপ করুন। হেপাটাইটিস নির্ণয় হলে কখনোই কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন না, কারণ এতে রোগ আরও জটিল হতে পারে।

উপসংহার:

হেপাটাইটিস একটি গুরুতর রোগ, তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য। আমাদের সামান্য সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে। লিভার আমাদের শরীরের একটি অমূল্য সম্পদ, আসুন আমরা সবাই মিলে এর যত্ন নিই।

আপনার সুস্থ জীবন কামনা করছি।

হেপাটাইটিস বিষয়ে কিছু নির্ভরযোগ্য সোর্স:

  1. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ – বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সরকারি ওয়েবসাইট, যেখানে হেপাটাইটিস এবং অন্যান্য রোগের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
    ওয়েবসাইট: www.dghs.gov.bd
  2. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) – হেপাটাইটিস বিষয়ে বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যান এবং তথ্য প্রদান করে থাকে।
    ওয়েবসাইট: www.who.int
  3. বাংলাদেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলি – যেমন, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল হেপাটাইটিস সোসাইটি (BCHS), যেখানে বিশেষজ্ঞরা হেপাটাইটিস সম্পর্কিত তথ্য ও চিকিৎসা প্রদান করে থাকে।
    ওয়েবসাইট: www.bchsbd.org
  4. সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) – হেপাটাইটিস সম্পর্কিত মহামারী, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিশ্বমানের তথ্য।
    ওয়েবসাইট: www.cdc.gov
  5. ভারতীয় হেপাটাইটিস ফাউন্ডেশন – ভারতে হেপাটাইটিস সম্পর্কিত সচেতনতা এবং তথ্য প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান।
    ওয়েবসাইট: www.hepfindia.org
  6. এশিয়ান সোসাইটি ফর হেপাটাইটিস – হেপাটাইটিস রোগের চিকিৎসা এবং নির্ণয়ের জন্য একটি গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম।
    ওয়েবসাইট: www.asianhepatitis.org
  7. হেপাটাইটিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ – বাংলাদেশের একটি সংগঠন যা হেপাটাইটিস বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে।
    ওয়েবসাইট: www.hsb.org.bd

এই সোর্সগুলি হেপাটাইটিস সম্পর্কে তথ্য এবং চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করে থাকে, যা জনগণের মধ্যে সচেতনতা এবং প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

Scroll to Top