
হেপাটাইটিস এ এর লক্ষণ: কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
হেপাটাইটিস এ হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা সাধারণত দূষিত খাবার বা পানি গ্রহণের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং অনেক সময় জ্বর, ক্লান্তি, বমি, পেট ব্যথা, চোখ বা ত্বকে হলুদভাবের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। হেপাটাইটিস এ যদিও সাধারণত গুরুতর নয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়, তবে সময়মতো লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই ব্লগে আলোচনা করবো হেপাটাইটিস এ রোগের প্রধান লক্ষণগুলো, সেই লক্ষণগুলোর ব্যাখ্যা, রোগটি শনাক্তকরণ এবং প্রাথমিক করণীয় বিষয়ে।
হেপাটাইটিস এ কি?
হেপাটাইটিস এ একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা লিভারকে আক্রমণ করে। এটি সাধারণত সংক্রমিত ব্যক্তির মল দ্বারা দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। হেপাটাইটিস এ সাধারণত তীব্র সংক্রমণ সৃষ্টি করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে, বিশেষ করে বয়স্ক বা দুর্বল ইমিউন সিস্টেমযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
হেপাটাইটিস এ এর কারণ:
হেপাটাইটিস এ ভাইরাস (HAV) মূলত ফেকো-ওরাল রুট (মলের মাধ্যমে মুখে সংক্রমণ) দ্বারা ছড়ায়। নিম্নলিখিত উপায়ে এই রোগ হতে পারে:
- দূষিত পানি পান করা – হেপাটাইটিস এ ভাইরাসযুক্ত পানি পান করলে সংক্রমণ হতে পারে।
- অপরিষ্কার খাবার খাওয়া – ফলমূল, শাকসবজি বা রান্না করা খাবার ভালোভাবে ধোয়া না হলে বা দূষিত হাতে তৈরি করা হলে সংক্রমণ হতে পারে।
- সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ – হেপাটাইটিস এ আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি যোগাযোগ বা তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র স্পর্শ করলে সংক্রমণ হতে পারে।
- অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন – টয়লেট ব্যবহারের পর হাত না ধুলে বা সঠিকভাবে স্যানিটেশন না থাকলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
হেপাটাইটিস এ এর লক্ষণ:
হেপাটাইটিস এ এর উপসর্গ সাধারণত সংক্রমণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পর দেখা দেয়। লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয়। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. জ্বর (জ্বর অনুভব করা বা শরীর গরম লাগা)
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর শরীরে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার জ্বর দেখা যায়। অনেক সময় এই জ্বর ফ্লু’র মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে।
২. ক্লান্তি ও দুর্বলতা
রোগীরা খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বলতা অনুভব করে। অনেক সময় ঘুম থেকে উঠেই আবার ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছা হয়।
৩. বমি ভাব ও বমি হওয়া
রোগীর খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায় এবং বমি ভাব বা প্রকৃত বমি হতে পারে। এটি হেপাটাইটিস এ-এর একটি সাধারণ উপসর্গ।
৪. পেটে অস্বস্তি বা ব্যথা (বিশেষ করে ডান পাশের পেট)
লিভার ডান পাশে অবস্থিত হওয়ায় অনেক সময় সেখানে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হয়। রোগীর পেট ফেঁপে যাওয়া বা অস্বস্তি লাগাও স্বাভাবিক।
৫. ক্ষুধামন্দা
রোগীর ক্ষুধা একেবারেই কমে যায় এবং খাবারের স্বাদেও পরিবর্তন আসে। অনেকে প্রিয় খাবার খেতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
৬. ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা
বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া হতে পারে। এতে শরীর থেকে পানি ও লবণের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
৭. চোখ ও ত্বকে হলুদভাব (জন্ডিস)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো চোখের সাদা অংশ ও ত্বকে হলুদ ভাব দেখা দেয়। এটি লিভারের সমস্যা বোঝায় এবং একে জন্ডিস বলা হয়।
৮. গা চুলকানি
চর্মে চুলকানি, বিশেষ করে জন্ডিস শুরু হওয়ার পর, রোগীদের অনেক সময় তীব্র গা চুলকানি দেখা যায়।
৯. গাঢ় প্রস্রাব
প্রস্রাবের রঙ সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি হলুদ বা প্রায় বাদামি হয়ে যায়, যা জন্ডিসের লক্ষণ নির্দেশ করে।
১০. মল-এর রঙ হালকা হয়ে যাওয়া
যখন লিভার স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন মলের রঙ হালকা বা ধূসর হয়ে যেতে পারে।
শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের উপসর্গে পার্থক্য:
- শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস এ অনেক সময় উপসর্গ ছাড়াই হতে পারে। কিন্তু তারা অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।
- প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো বেশি প্রকটভাবে প্রকাশ পায় এবং ক্লান্তি বা দুর্বলতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
হেপাটাইটিস এ এর জটিলতা:
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস এ নিজে থেকেই সেরে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সৃষ্টি করে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা দিতে পারে:
- তীব্র লিভার ফেইলিউর (Fulminant Hepatitis) – খুব কম ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস এ তীব্র লিভার ড্যামেজ করতে পারে, যা জীবনঘাতী হতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি – কিছু রোগী সুস্থ হওয়ার পরও কয়েক মাস ধরে দুর্বলতা অনুভব করতে পারেন।
- পুনরায় সংক্রমণ – একবার হেপাটাইটিস এ হলে সাধারণত এটি দ্বিতীয়বার হয় না, কারণ শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
হেপাটাইটিস এ এর চিকিৎসা:
হেপাটাইটিস এ এর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই, কারণ এটি সাধারণত নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে নিম্নলিখিত উপায়ে রোগীর অবস্থার উন্নতি করা যায়:
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
- রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে, কারণ লিভার রিকভারির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
২. পুষ্টিকর খাবার
- হালকা ও সহজপাচ্য খাবার – ভাত, ডাল, সবজির স্যুপ, মুরগির মাংস ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
- ফল ও শাকসবজি – তাজা ফল (যেমন: পেঁপে, আপেল) এবং সবজি খেতে হবে।
- পর্যাপ্ত পানি – পানিশূন্যতা রোধ করতে বেশি করে পানি, ডাবের পানি ও ফলের রস পান করুন।
৩. ওষুধের ব্যবহার
- জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল – তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করবেন না।
- বমি রোধে ওষুধ – বমি বমি ভাব কমাতে ডাক্তার এন্টি-নausea ওষুধ দিতে পারেন।
৪. অ্যালকোহল ও ভারী খাবার এড়িয়ে চলা
- লিভারকে সুস্থ রাখতে অ্যালকোহল ও তৈলাক্ত খাবার সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে হবে।
হেপাটাইটিস এ রোগ নির্ণয়:
রোগ নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পরীক্ষা করা হয়ে থাকে:
- রক্ত পরীক্ষা: SGPT/ALT, Bilirubin, HAV IgM টেস্ট
- প্রস্রাব পরীক্ষা: প্রস্রাবে ইউরোবিলিনোজেন ও বিলিরুবিন মাত্রা পরিমাপ
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?
নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর মধ্যে এক বা একাধিক থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- ৩ দিনের বেশি সময় ধরে জ্বর থাকলে
- চোখ ও ত্বকে হলুদ ভাব দেখা দিলে
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে গেলে
- খাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলে
- অতিরিক্ত দুর্বলতা বা বমি শুরু হলে
হেপাটাইটিস এ-তে করণীয় ও প্রতিকার:
✅ বিশ্রাম: রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে। বেশি পরিশ্রম শরীরকে আরও দুর্বল করে দেয়।
✅ পর্যাপ্ত পানি ও তরল পান: শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পানি, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, স্যুপ খাওয়া উচিত।
✅ সহজপাচ্য খাবার খাওয়া: হালকা ও সহজপাচ্য খাবার যেমন ভাত, খিচুড়ি, সেদ্ধ সবজি, ফলমূল খাওয়া দরকার।
✅ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ: সাধারণত হেপাটাইটিস এ ভাইরাস নিজেই নিরাময়যোগ্য। তবে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করা উচিত।
✅ ভিটামিন ও পুষ্টিকর খাদ্য: রোগীকে পর্যাপ্ত ভিটামিন এ, বি, সি, ও ই যুক্ত খাবার দিতে হবে যা লিভারের সুস্থতায় সহায়তা করে।
হেপাটাইটিস এ- প্রতিরোধের উপায়:
হেপাটাইটিস এ প্রতিরোধে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে:
🧼 হাত ধোয়ার অভ্যাস: খাবার খাওয়ার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
💧 বিশুদ্ধ পানি পান: সবসময় ফুটানো পানি বা বিশুদ্ধ বোতলজাত পানি পান করুন।
🍽️ পরিষ্কার খাবার গ্রহণ: রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলুন এবং ঘরে তৈরি খাবার খান।
💉 ভ্যাকসিন গ্রহণ: হেপাটাইটিস এ এর জন্য টিকা উপলব্ধ রয়েছে। এটি বিশেষ করে শিশু ও ভ্রমণকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার:
হেপাটাইটিস এ সাধারণত আত্ম-নিরাময়যোগ্য রোগ হলেও, উপসর্গগুলো চিহ্নিত করে যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। চোখ বা ত্বকে হলুদ ভাব, দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, বমি ভাব ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। একইসাথে, রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও টিকা গ্রহণ করাও অত্যন্ত কার্যকর।
সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন, হেপাটাইটিস এ থেকে নিজেকে ও আপনার প্রিয়জনকে সুরক্ষিত রাখুন।