ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়

ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়?

ডায়াবেটিস একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর রোগ, যা আমাদের শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিন ব্যবহারের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ এবং সিস্টেমে ক্ষতি করতে পারে। সাধারণত, ডায়াবেটিস দুই ধরনের হয়ে থাকে—টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে ইনসুলিন পুরোপুরি কাজ করতে পারে না এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ইনসুলিনের প্রতি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে, যা একে একে বিভিন্ন অঙ্গ এবং সিস্টেমে ক্ষতি করে। আজকের এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব, ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হতে পারে এবং এর প্রতিকার কী হতে পারে।

ডায়াবেটিস সমস্যা গুলো হলো:

১. চোখের সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। একে বলা হয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। উচ্চ রক্তশর্করা চোখের রেটিনায় ক্ষতি করতে পারে, যার ফলে দৃষ্টিশক্তি কমে যায় বা অন্ধত্ব পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, ডায়াবেটিসের কারণে মায়োপিয়া (নিকটদৃষ্টির সমস্যা) বা হাইপারমেট্রোপিয়া (দূরদৃষ্টির সমস্যা) হতে পারে।

২. হৃদরোগ ও স্ট্রোক

ডায়াবেটিসের কারণে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। শরীরে অতিরিক্ত শর্করা রক্তনালীর দেয়ালগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্টের সমস্যা তৈরি করে। এছাড়া, ডায়াবেটিস হলে রক্তের শর্করা বেশি থাকার ফলে রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ে, যা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।

৩. কিডনি সমস্যা

ডায়াবেটিস কিডনির উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ রক্তশর্করা কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে কিডনি বিকল হতে পারে। এটি কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে, ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়তে পারে।

৪. পায়ের সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে পায়ে সংবেদনশীলতা কমে যেতে পারে, যার ফলে ক্ষত বা সোর সৃষ্টি হতে পারে। রক্ত চলাচলও কমে যেতে পারে, ফলে পায়ে প্রদাহ বা ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে, যা ঠিক হতে অনেক সময় লাগে। এই ধরনের পরিস্থিতি যদি অবহেলা করা হয়, তবে পায়ে গ্যাংগ্রিন পর্যন্ত হতে পারে এবং অবশেষে পা কেটে ফেলতে হতে পারে।

৫. স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি)

ডায়াবেটিস স্নায়ুতন্ত্রের উপরও প্রভাব ফেলে। একে বলা হয় ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি। এতে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, ঝিনঝিন করা, অনুভূতির অভাব, গা ঘোরানো বা পা জড়িয়ে যাওয়া মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণত হাত, পা এবং গলার দিকে বেশি হয়।

৬. ত্বক ও পোশাকের সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে ত্বকে আর্দ্রতা কমে যায় এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। এছাড়া, ত্বকে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন বা ক্ষত হতে পারে, যেমন ফাঙ্গাল ইনফেকশন (যেমন, পায়ের ফাঙ্গাস)। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ত্বক ঠান্ডা বা গরমে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এছাড়া, ঘাঁ বা আলসারও সহজে হতে পারে, যা সুস্থ হতে অনেক সময় নেয়।

৭. মূত্রনালী সংক্রান্ত সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে মূত্রনালীতে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন, ঘন ঘন মূত্রত্যাগ, মূত্রথলির অতিরিক্ত পূর্ণতা অনুভূতি, বা মূত্রনালীর ইনফেকশন। দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস থাকলে, মূত্রনালীতে পাথরও হতে পারে।

৮. যৌন সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে পুরুষদের মধ্যে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (লিঙ্গ উত্তেজিত না হওয়া) হতে পারে। মহিলাদের মধ্যে মেন্সট্রুয়াল সাইকেল সম্পর্কিত সমস্যা এবং যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে ব্লাড সঞ্চালন ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির কারণে এই সমস্যা হতে পারে।

৯. মস্তিষ্কের সমস্যা

ডায়াবেটিস মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাও প্রভাবিত করতে পারে। এটি মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়, যার ফলে স্মৃতিশক্তি বা মস্তিষ্কের অন্যান্য কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। অতিরিক্ত শর্করা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতির সমস্যা হতে পারে।

১০. ওজন বৃদ্ধির সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ওজন বৃদ্ধি হতে পারে। বিশেষত, টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার বা হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে দ্রুত ওজন বাড়তে পারে।

ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির উপায়:

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ পরামর্শ যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে:

  • সুস্থ খাদ্যাভ্যাস: সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, তাজা খাবার, কম চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইকেল চালানো বা অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন কমাতে চেষ্টা করুন, কারণ এটি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
  • রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত রক্ত শর্করা পরীক্ষা করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন বা ওষুধ নিন।

সতর্কতা:

এই ব্লগে দেওয়া তথ্য সাধারণ উদ্দেশ্যে। আপনাকে যদি ডায়াবেটিস বা কোনো অন্যান্য শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা নিয়ে পরামর্শ প্রয়োজন হয়, তবে একজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।

উপসংহার:

ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, কিন্তু সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এই রোগের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে এর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং সময়মতো চিকিৎসা নিন।

Scroll to Top