টিউবারকুলোসিস কি

টিউবারকুলোসিস কি? আসুন জেনে নেই

টিউবারকুলোসিস (TB) একটি জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণ যা মূলত শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, যেটি মানুষের শ্বাসনালী, ফুসফুস এবং কখনও কখনও অন্যান্য অঙ্গেও আক্রমণ করতে পারে। যদিও এটি একটি পুরনো রোগ, তবুও আজও বিশ্বজুড়ে এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, টিউবারকুলোসিস এখনও একটি অন্যতম কারণ হিসেবে মৃত্যু ঘটায়।

এটি সাধারণত Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়। এটি এমন একটি রোগ যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এক ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আজকে আমরা টিউবারকুলোসিস কি, এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

টিউবারকুলোসিস কি?

টিউবারকুলোসিস (Tuberculosis) বা যক্ষ্মা ,সংক্ষেপে টিবি (TB) একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। এই রোগটি Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এটি প্রধানত ফুসফুসে আক্রমণ করে, তবে এটি হাড়, মস্তিষ্ক, কিডনি, লিভার বা শরীরের অন্য কোনো অংশেও ছড়াতে পারে। টিবি একটি সংক্রামক রোগ, অর্থাৎ এটি একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়াতে পারে।

টিবি কিভাবে ছড়ায়?

টিবি রোগটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। যখন একজন টিবি আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি, হাঁচি বা কথা বলেন, তখন তার মুখ থেকে ছোট ছোট জলকণার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য কোনো ব্যক্তি যদি সেই সংক্রামিত বাতাস শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি টিবি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।

তবে মনে রাখবেন, টিবি ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হওয়া মানেই এই নয় যে আপনি টিবি রোগে আক্রান্ত হবেন। অনেক সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, এবং এটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই অবস্থাকে ল্যাটেন্ট টিবি (Latent TB) বলা হয়। কিন্তু যদি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে এই ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হয়ে টিবি রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

টিবি রোগের লক্ষণ:

টিবি রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো খুবই সাধারণ মনে হতে পারে, যেমন:

  1.   দীর্ঘস্থায়ী কাশি: তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাশি থাকা, এবং কাশির সাথে কফ বা রক্ত যাওয়া।
  2.   জ্বর: হালকা জ্বর, বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে।
  3.   ওজন কমে যাওয়া: কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমতে থাকা।
  4.   ক্ষুধামন্দা: খাবারে রুচি কমে যাওয়া।
  5.   ক্লান্তি ও দুর্বলতা: সারাদিন ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অনুভব করা।
  6.   রাতে ঘাম: রাতের বেলা অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।

যদি টিবি ফুসফুসের বাইরে অন্য কোনো অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেই অঙ্গের উপর নির্ভর করে লক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে। যেমন, হাড়ের টিবি হলে হাড়ে ব্যথা, মস্তিষ্কের টিবি হলে মাথাব্যথা বা খিঁচুনি হতে পারে।

কাদের টিবি হওয়ার ঝুঁকি বেশি?

কিছু মানুষের টিবি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যেমন:

  1.   দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: এইচআইভি/এইডস, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের টিবি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  2.   ধূমপান ও মদ্যপান: ধূমপান এবং মদ্যপান ফুসফুসের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা টিবি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
  3.   অপুষ্টি: অপুষ্টিতে ভোগা ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়, ফলে টিবি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

4.   ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ: যারা ঘনবসতিপূর্ণ এবং বায়ু চলাচল না হয় এমন জায়গায় বসবাস করেন, তাদের মধ্যে টিবি ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।

টিবি রোগের পরীক্ষা:

টিবি রোগ সন্দেহ হলে ডাক্তার কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন:

  1.   কফ পরীক্ষা: কফের নমুনা নিয়ে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে টিবি ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়।
  2.   স্কিন টেস্ট (মান্টু টেস্ট): এই পরীক্ষায় হাতে একটি ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং ৪৮-৭২ ঘন্টা পরে ফলাফল দেখা হয়।
  3.   ব্লাড টেস্ট: রক্তের নমুনা নিয়ে টিবি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।

4.   চেস্ট এক্স-রে: ফুসফুসের অবস্থা বোঝার জন্য চেস্ট এক্স-রে করা হয়।

টিবি রোগের চিকিৎসা:

টিবি রোগের চিকিৎসা সম্ভব এবং এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তবে চিকিৎসা শুরু করার পর নিয়মিত ওষুধ সেবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টিবি রোগের চিকিৎসায় সাধারণত ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়। এই ওষুধগুলো সঠিক সময়ে এবং সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা জরুরি। যদি চিকিৎসা অর্ধেক রেখে দেওয়া হয়, তাহলে টিবি ব্যাকটেরিয়া ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে, যা চিকিৎসাকে আরও কঠিন করে তোলে।

টিবি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু সাধারণ ওষুধের নাম হলো:

  •         আইসোনিয়াজিড (Isoniazid)
  •         রিফাম্পিসিন (Rifampicin)
  •         পাইরাজিনামাইড (Pyrazinamide)
  •         ইথামবিউটল (Ethambutol)

টিবি প্রতিরোধের উপায়:

টিবি রোগ প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  1.   টিকা নেওয়া: বিসিজি (BCG) টিকা টিবি প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই টিকা সাধারণত শিশুদের দেওয়া হয়।
  2.   সচেতনতা: টিবি আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুখোশ পরা।
  3.   স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা এবং শরীরচর্চা করা।
  4.   ঘরের বায়ু চলাচল: ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা।

5.   নিয়মিত চেকআপ: যদি টিবি হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাহলে নিয়মিত চেকআপ করানো উচিত।

টিবি নিয়ে কিছু ভুল ধারণা:

টিবি নিয়ে অনেকের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন:

  1.   টিবি শুধু গরিব মানুষের রোগ: এটি সত্য নয়। টিবি যে কারও হতে পারে, তবে দরিদ্র এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসকারী মানুষের ঝুঁকি বেশি।
  2.   টিবি ছোঁয়াচে নয়: টিবি একটি সংক্রামক রোগ, যা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।

3.   টিবি নিরাময়যোগ্য নয়: টিবি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য, যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়।

টিবি রোগের জটিলতা:

যদি টিবি রোগের চিকিৎসা সঠিক সময়ে শুরু না করা হয়, তাহলে এটি মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন:

  1.   ফুসফুসের ক্ষতি: টিবি ফুসফুসের টিস্যুকে ধ্বংস করে দিতে পারে, যা শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।
  2.   অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়া: টিবি ফুসফুস থেকে রক্তের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমন হাড়, মস্তিষ্ক, কিডনি ইত্যাদি।
  3. ওষুধ প্রতিরোধী টিবি: যদি চিকিৎসা অর্ধেক রেখে দেওয়া হয়, তাহলে টিবি ব্যাকটেরিয়া ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে, যা চিকিৎসাকে কঠিন করে তোলে।

টিবি রোগের সামাজিক প্রভাব:

টিবি শুধু শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে না, এটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাও তৈরি করে। টিবি আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কারণ অনেকে এই রোগকে ভয় পান। এছাড়া, দীর্ঘদিনের চিকিৎসা এবং ওষুধের খরচ অনেক পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

টিবি রোগের চিকিৎসায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ:

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে টিবি রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে টিবি রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া হয়, এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিবি রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) টিবি নির্মূলের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি চালাচ্ছে।

উপসংহার:

টিউবারকুলোসিস বা টিবি একটি গুরুতর রোগ, কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। টিবি সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি বা আপনার আশেপাশের কেউ টিবি রোগের লক্ষণ দেখেন, তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সচেতনতাই পারে টিবি প্রতিরোধ করতে।

Scroll to Top