
যক্ষা রোগের টিকার নাম কি:
যক্ষা বা টিবি (Tuberculosis) একটি প্রাণঘাতী রোগ, যা মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এটি প্রধানত ফুসফুসে আক্রমণ করে, তবে শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন হাড়, কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদিতেও ছড়াতে পারে। যক্ষা রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে টিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যক্ষা রোগের টিকার নাম, এর কার্যকারিতা, গুরুত্ব এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে আলোচনা করব।
যক্ষা রোগের টিকার নাম কি?
যক্ষা প্রতিরোধে ব্যবহৃত টিকার নাম BCG (Bacillus Calmette-Guérin) টিকা। এটি যক্ষার বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদানকারী একমাত্র অনুমোদিত টিকা।
BCG টিকার ইতিহাস
- ১৯২১ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী Albert Calmette এবং Camille Guérin যৌথভাবে এই টিকা আবিষ্কার করেন।
- এটি মূলত গরুর যক্ষা (Mycobacterium bovis) থেকে তৈরি করা হয়েছে।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটি ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক টিকা হিসেবে সুপারিশ করেছে।
BCG টিকা কাদের দেওয়া হয়?
বিসিজি ভ্যাকসিন যক্ষা রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে, তবে এটি ১০০% কার্যকর নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই টিকা শিশুদের মধ্যে যক্ষা রোগের গুরুতর রূপ যেমন মেনিনজাইটিস এবং মিলিয়ারি টিবি প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। তবে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা কিছুটা কম।
১. নবজাতক ও শিশুদের জন্য
- সাধারণত জন্মের পরপরই বা ৬ সপ্তাহের মধ্যে BCG টিকা দেওয়া হয়।
- বিশেষ করে যেসব দেশে যক্ষার প্রকোপ বেশি, সেখানে এটি বাধ্যতামূলক।
- এই টিকা শিশুর টিউবারকুলোসিস মেনিনজাইটিস এবং ডিসেমিনেটেড TB থেকে সুরক্ষা দেয়।
২. প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য
- সাধারণত BCG টিকা প্রাপ্তবয়স্কদের দেওয়া হয় না।
- তবে কিছু নির্দিষ্ট পেশার মানুষ (যেমন স্বাস্থ্যকর্মী) বা উচ্চ-ঝুঁকির ব্যক্তিরা এটি নিতে পারেন।
৩. যক্ষার সংক্রমণ হয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য
- যদি কেউ ইতোমধ্যে TB-তে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এই টিকা কার্যকর নয়।
- এটি কেবল প্রতিরোধমূলক ব্যবহারের জন্য উপযোগী।
BCG টিকা কীভাবে কাজ করে?
BCG টিকা মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং যক্ষার জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
টিকা গ্রহণের পর কী ঘটে?
- টিকা গ্রহণের পর শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) সক্রিয় হয়ে ওঠে।
- এটি TB জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরকে প্রতিরোধী করে তোলে।
- শিশুদের ক্ষেত্রে এটি গুরুতর যক্ষার সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
BCG টিকার কার্যকারিতা
- নবজাতকদের ক্ষেত্রে ৮০% পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
- প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে কম।
- টিকা গ্রহণের ১০-১৫ বছর পর এর কার্যকারিতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।
BCG টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
BCG টিকার কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তবে সেগুলো সাধারণত গুরুতর নয়।
সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- টিকা দেওয়ার স্থানে লালচে ফোলাভাব
- চুলকানি ও হালকা ব্যথা
- ১-২ সপ্তাহ পরে ছোট ফোস্কা বা ঘা দেখা দিতে পারে
- ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পর ছোট দাগ থাকতে পারে (এটি স্বাভাবিক)
গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (বিরল)
- গুরুতর অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া (Anaphylaxis)
- ইনফেকশন বা ফোলা লিম্ফ নোড
- হাড়ের সংক্রমণ (Osteitis)
- ইমিউনো-কম্প্রোমাইজড ব্যক্তিদের মধ্যে গুরুতর সংক্রমণ
বিসিজি টিকা দেওয়ার আগে সতর্কতা:
বিসিজি টিকা দেওয়ার আগে কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন:
- ইমিউনো কম্প্রোমাইজড ব্যক্তি: যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যেমন এইডস রোগী বা কেমোথেরাপি নেওয়া রোগী, তাদের এই টিকা দেওয়া উচিত নয়।
- গর্ভবতী মহিলা: গর্ভাবস্থায় এই টিকা দেওয়া এড়ানো উচিত।
3. টিকার প্রতি অ্যালার্জি: যদি কারো টিকার কোনো উপাদানের প্রতি অ্যালার্জি থাকে, তাহলে এই টিকা দেওয়া উচিত নয়।
BCG টিকা সম্পর্কে সাধারণ ভুল ধারণা:
❌ BCG টিকা যক্ষা নিরাময় করতে পারে – এটি সত্য নয়
BCG টিকা শুধুমাত্র প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, এটি TB নিরাময় করতে পারে না।
❌ যারা BCG টিকা নিয়েছে, তারা যক্ষায় আক্রান্ত হবে না – এটি সত্য নয়
যারা এই টিকা নিয়েছে, তারা যক্ষা সংক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। তবে, গুরুতর যক্ষা সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
❌ BCG টিকা সারা জীবনের জন্য সুরক্ষা দেয় – এটি সত্য নয়
BCG টিকার কার্যকারিতা ১০-১৫ বছর পরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
BCG টিকা নেওয়ার জন্য নির্দেশিকা:
যেসব ক্ষেত্রে BCG টিকা নেওয়া উচিত নয়
- যারা ইতোমধ্যে যক্ষার সংক্রমণে আক্রান্ত
- যাদের HIV/AIDS বা অন্যান্য রোগের কারণে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল
- যারা গুরুতর ত্বকের সংক্রমণে আক্রান্ত
- যারা গর্ভবতী (গর্ভাবস্থায় এটি সুপারিশ করা হয় না)
বিসিজি টিকা এবং যক্ষা রোগের চিকিৎসা:
বিসিজি টিকা যক্ষা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, তবে এটি যক্ষা রোগের চিকিৎসা নয়। যদি কেউ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার জন্য সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। যক্ষা রোগের চিকিৎসায় সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, যেমন আইসোনিয়াজিড, রিফামপিসিন, ইথামবুটল এবং পাইরাজিনামাইড। এই ওষুধগুলি ৬ থেকে ৯ মাস ধরে নিয়মিত সেবন করতে হয়।
যক্ষা রোগের লক্ষণ
যক্ষা রোগের লক্ষণগুলি রোগের ধরন এবং আক্রান্ত অঙ্গের উপর নির্ভর করে। ফুসফুসের যক্ষা রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি হলো:
- তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাশি।
- কাশির সাথে রক্ত যাওয়া।
- ওজন হ্রাস।
- জ্বর এবং রাতের ঘাম।
- দুর্বলতা এবং ক্লান্তি।
যদি এই লক্ষণগুলি দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
যক্ষা প্রতিরোধের অন্যান্য উপায়:
BCG টিকার পাশাপাশি কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে যক্ষা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
✅ স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করুন
- পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খান
- পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন
- ধূমপান ও মাদক এড়িয়ে চলুন
✅ পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন
- যেখানে থাকেন বা কাজ করেন, সেখানে ভালোভাবে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন।
- যক্ষার জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই বন্ধ ঘরে বেশি সময় থাকবেন না।
✅ হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন
- হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখুন
- যক্ষার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
বিসিজি টিকা নেওয়ার গুরুত্ব:
বিসিজি টিকা নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে যেসব দেশে যক্ষা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এই টিকা শিশুদের যক্ষা রোগের গুরুতর রূপ থেকে রক্ষা করে এবং মৃত্যুর হার কমায়। এছাড়াও, এটি যক্ষা রোগের বিস্তার রোধে সাহায্য করে।
পরামর্শ:
যদি আপনার বা আপনার পরিবারের কারও যক্ষার ঝুঁকি থাকে, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে BCG টিকা গ্রহণ করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন!
উপসংহার:
যক্ষা একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ, তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। BCG টিকা নবজাতক এবং শিশুদের গুরুতর যক্ষা থেকে রক্ষা করতে অত্যন্ত কার্যকর। যদিও এটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারে না, তবুও এটি যক্ষা প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
সঠিক সময়ে BCG টিকা গ্রহণ করুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং যক্ষা প্রতিরোধে সচেতন হোন।