ইমার্জেন্সি পিলের নাম ও দাম

ইমার্জেন্সি পিলের নাম ও দাম:

বর্তমান সময়ে অনেক নারী অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ এড়াতে ইমার্জেন্সি পিলের সাহায্য নিচ্ছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যা শুধু জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা উচিত। তবে অনেকেই ঠিকঠাকভাবে জানেন না এই পিল কী, কীভাবে কাজ করে, কোন পিল কোথায় পাওয়া যায় এবং এর দাম কত।

ইমার্জেন্সি পিল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এটি ব্যবহারের প্রয়োজনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ইমার্জেন্সি পিল কি?

ইমার্জেন্সি পিল, যাকে “মর্নিং আফটার পিল” বা “জরুরি গর্ভনিরোধক” ও বলা হয়, একটি হরমোন-ভিত্তিক ওষুধ যা অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের পরে গর্ভধারণ এড়াতে ব্যবহৃত হয়।

এই পিল মূলত দুই ধরনের হতে পারে:

  1. লেভোনরজেস্ট্রেল (Levonorgestrel): ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খেতে হয়।

     

  2. ইউলিপ্রিস্টাল অ্যাসিটেট (Ulipristal Acetate): ১২০ ঘণ্টা বা ৫ দিনের মধ্যে খাওয়া যায়।

⚠️ মনে রাখবেন: ইমার্জেন্সি পিল গর্ভপাতের ওষুধ নয়! এটি শুধুমাত্র গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে।

কেন এই পিল ব্যবহারের প্রয়োজন হয়?

নিয়মিত গর্ভনিরোধক না নেওয়া, কনডম ফেটে যাওয়া বা ধর্ষণের মতো পরিস্থিতিতে জরুরি গর্ভনিরোধক পিল প্রয়োজন হতে পারে। নিচে কিছু পরিস্থিতি তুলে ধরা হলো:

  • কনডম ছিঁড়ে গেছে বা ঠিকভাবে ব্যবহার হয়নি

  • গর্ভনিরোধক পিল ভুলে গেছেন

  • কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করা

  • অনিচ্ছাকৃত বা জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক

ইমার্জেন্সি পিল কখন কার্যকর হয়?

সময়

কার্যকারিতা

২৪ ঘণ্টার মধ্যে

৯৫% পর্যন্ত কার্যকর

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে

৮৫% কার্যকর

৭২ ঘণ্টার মধ্যে

৫৮% পর্যন্ত কার্যকর

১২০ ঘণ্টার মধ্যে (Ulipristal)

প্রায় ৯৮% কার্যকর

উল্লেখযোগ্য: সময় যত দ্রুত হবে, পিল তত ভালো কাজ করবে।

বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন ইমার্জেন্সি পিলের নাম ও দাম:

বাংলাদেশে কিছু নামকরা ওষুধ কোম্পানি ইমার্জেন্সি পিল বাজারজাত করেছে। নিচে সবচেয়ে প্রচলিত নাম ও তাদের আনুমানিক মূল্য দেওয়া হলো:

১. Postinor-2 (পোস্টিনর-২)

  • উৎপাদক: Gedeon Richter, Hungary

  • উপাদান: Levonorgestrel 0.75mg × ২ ট্যাবলেট

  • মূল্য: আনুমানিক ৮০-১২০ টাকা

  • ব্যবহার: প্রথম ট্যাবলেট যত দ্রুত সম্ভব (৭২ ঘণ্টার মধ্যে) খেতে হবে, দ্বিতীয়টি প্রথমটার ১২ ঘণ্টা পর।

২. Emcon-1 (ইমকন-১)

  • উৎপাদক: Renata Ltd.

  • উপাদান: Levonorgestrel 1.5mg (একটি ট্যাবলেট)

  • মূল্য: আনুমানিক ৫০-৭০ টাকা

  • ব্যবহার: একবারেই একটি পিল খেতে হয়, যত দ্রুত সম্ভব।

৩. Femipil (ফেমিপিল)

  • উৎপাদক: Popular Pharmaceuticals Ltd.

  • উপাদান: Levonorgestrel 1.5mg

  • মূল্য: আনুমানিক ৫০-৬৫ টাকা

  • ব্যবহার: একবার খেতে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

৪. NorLevo (নরলেভো)

  • উৎপাদক: Biogaran (France), বাংলাদেশে কিছু ফার্মেসিতে পাওয়া যায়

  • মূল্য: ১২০-১৫০ টাকা (ভিন্ন ফার্মেসিতে দাম ভিন্ন হতে পারে)

৫. আই-পিল (I-Pill)

  • সক্রিয় উপাদান: লেভোনরজেস্ট্রেল (1.5 mg)
  • দাম: ৳৩০-৳৪০ (১ টি বড়ি)
  • ব্যবহারবিধি: অরক্ষিত মিলনের ৭২ ঘন্টার (৩ দিন) মধ্যে ১ টি বড়ি খেতে হবে। যত দ্রুত খাওয়া যায়, তত বেশি কার্যকর।

৬. সেফটি পিল (Safety Pill)

  • সক্রিয় উপাদান: লেভোনরজেস্ট্রেল (1.5 mg)
  • দাম: ৳৩৫-৳৫০ (১ টি বড়ি)
  • ব্যবহারবিধি: অরক্ষিত মিলনের ৭২ ঘন্টার মধ্যে ১ টি বড়ি খেতে হবে।

৭. লেডি পিল (Lady Pill)

  • সক্রিয় উপাদান: লেভোনরজেস্ট্রেল (1.5 mg)
  • দাম: ৳৪০-৳৬০ (১ টি বড়ি)
  • ব্যবহারবিধি: অরক্ষিত মিলনের ৭২ ঘন্টার মধ্যে ১ টি বড়ি খেতে হবে।

৮. নরগেস্ট (Norgest)

  • সক্রিয় উপাদান: লেভোনরজেস্ট্রেল (1.5 mg)
  • দাম: ৳৩৫-৳৫০ (১ টি বড়ি)
  • ব্যবহারবিধি: অরক্ষিত মিলনের ৭২ ঘন্টার মধ্যে ১ টি বড়ি খেতে হবে।

৯. ইমার্জেন্সি (Emergency)

  • সক্রিয় উপাদান: লেভোনরজেস্ট্রেল (1.5 mg)
  • দাম: ৳৩০-৳৪৫ (১ টি বড়ি)
  • ব্যবহারবিধি: অরক্ষিত মিলনের ৭২ ঘন্টার মধ্যে ১ টি বড়ি খেতে হবে।

১০. ইউলিপ্রিস্টাল অ্যাসিটেট (Ulipristal Acetate – EllaOne)

  • সক্রিয় উপাদান: ইউলিপ্রিস্টাল অ্যাসিটেট (30 mg)
  • দাম: ৳৫০০-৳৮০০ (১ টি বড়ি)

ব্যবহারবিধি: অরক্ষিত মিলনের ১২০ ঘন্টার (৫ দিন) মধ্যে ১ টি বড়ি খেতে হবে। এটি লেভোনরজেস্ট্রেলের চেয়ে বেশি কার্যকর।

ইমার্জেন্সি পিল কীভাবে কাজ করে?

ইমার্জেন্সি পিল মূলত গর্ভধারণ প্রতিরোধের জন্য হরমোন নির্ভর ওষুধ। এটি ডিম্বাণু নির্গমন (ovulation) বিলম্বিত করে অথবা নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে সংযুক্ত হতে বাধা দেয়। এর ফলে গর্ভধারণের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

মূল কার্যপ্রণালি তিনটি হতে পারে:

  1. ডিম্বাণু বের হওয়া বিলম্ব করে: ফলে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না।
  2. নিষিক্ত ডিম্বাণুর জরায়ুতে স্থাপন আটকে দেয়: যদি ইতিমধ্যে নিষিক্ত হয়ে যায়।
  3. সার্ভিকাল মিউকাস ঘন করে: ফলে শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে যেতে পারে না।

মনে রাখবেন: পিলটি গর্ভপাত ঘটায় না। যদি গর্ভসঞ্চার ইতিমধ্যে ঘটে যায়, তাহলে এটি গর্ভপাত ঘটাতে সক্ষম নয়।

ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার নিয়ম ও সতর্কতা:

পিল খাওয়ার সময় কিছু নিয়ম অবশ্যই মানতে হবে। ভুলভাবে বা দেরিতে খেলে এটি কার্যকর নাও হতে পারে।

✅ খাওয়ার নিয়ম:

  • Postinor-2: ১ম পিল যৌন সম্পর্কের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে, ২য় পিল ১২ ঘণ্টা পরে।

  • Emcon-1 / Femipil: মাত্র ১টি পিল খেতে হয়, সম্পর্কের যত দ্রুত সম্ভব পরে, সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে।

⚠️ সতর্কতা:

  • খালি পেটে খেলে অনেকের বমি ভাব হতে পারে।

  • বমি হলে পিল খাওয়ার ২ ঘণ্টার মধ্যে হলে আবার খেতে হতে পারে।

  • পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে আবার যৌনসম্পর্ক হলে, পুনরায় গর্ভধারণের ঝুঁকি থাকে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কী করবেন?

ইমার্জেন্সি পিল নেওয়ার পরে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যদিও এগুলো সাধারণত সাময়িক।

সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

  • মাথা ঘোরা বা দুর্বল লাগা

  • বমি বা বমি ভাব

  • বুকে টান বা ব্যথা

  • মেজাজ পরিবর্তন

  • অনিয়মিত বা আগেভাগে মাসিক শুরু

গুরুতর সমস্যা হলে যা করবেন:

  • অতিরিক্ত রক্তপাত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

  • মাসিক ৭-১০ দিন পেছালে প্রেগনেন্সি টেস্ট করুন

  • বুক ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হলে জরুরি সেবা নিন

বারবার খেলে কী সমস্যা হতে পারে?

ইমার্জেন্সি পিলকে “জরুরি” গর্ভনিরোধক বলা হয় কারণ এটি নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিকল্প নয়। বারবার ব্যবহার করলে কী হতে পারে:

  • হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়

     

  • মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়

     

  • ভবিষ্যতে গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে

     

  • শরীরে বিভিন্ন হরমোন-সম্পর্কিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়

     

👉 তাই প্রতি মাসে একবারের বেশি এই পিল ব্যবহার করা উচিত নয়।

কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা:

অনেকের মাঝেই ইমার্জেন্সি পিল নিয়ে ভুল তথ্য বা মিথ প্রচলিত আছে। নিচে সেগুলোর কিছু তুলে ধরা হলো:

❗ ভুল ধারণা ১: ইমার্জেন্সি পিল গর্ভপাত ঘটায়

সত্য: এটি গর্ভপাত ঘটায় না, বরং গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে।

❗ ভুল ধারণা ২: একবার খেলে ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়া যাবে না

সত্য: এটি একবার খেলে স্থায়ী প্রভাব ফেলে না।

❗ ভুল ধারণা ৩: এটি যৌন রোগ থেকে রক্ষা করে

সত্য: ইমার্জেন্সি পিল কেবল গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে, যৌনবাহিত রোগ (STI) প্রতিরোধ করে না।

চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া কবে দরকার?

ইমার্জেন্সি পিল সাধারণত ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ:

  • যদি আপনি নিয়মিত মাসিক না পান

  • যদি ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেছে

  • যদি গর্ভসঞ্চার হয়ে গিয়েছে বলে সন্দেহ হয়

  • পূর্বে হরমোনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে

বিকল্প গর্ভনিরোধক পদ্ধতির তালিকা:

ইমার্জেন্সি পিল শুধু জরুরি অবস্থায়, কিন্তু নিয়মিত গর্ভনিরোধের জন্য নিচের যেকোনো পদ্ধতি গ্রহণ করা নিরাপদ ও কার্যকর:

পদ্ধতি

ধরণ

কার্যকারিতা

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল

প্রতিদিন খেতে হয়

৯৯% পর্যন্ত

কনডম

Barrier

৯৮%

IUD (কপার টি)

৫-১০ বছর কার্যকর

৯৯%

ইনজেকশন

প্রতি ৩ মাসে

৯৪%

ইমপ্ল্যান্ট

৩-৫ বছর

৯৯%

উপসংহার:

ইমার্জেন্সি পিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গর্ভনিরোধক, তবে এটি শুধুমাত্র জরুরি সময়েই ব্যবহারযোগ্য। সঠিকভাবে ও সময়মতো গ্রহণ করলে এটি কার্যকর, তবে নিয়মিত ব্যবহার একদমই ঠিক নয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে, এবং নিজ শরীরকে বুঝে নিয়ে ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আপনি যদি নিয়মিত গর্ভনিরোধ চান, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অন্য কোনো স্থায়ী ও নিরাপদ পদ্ধতি বেছে নিন।

শেষ কথাঃ

ইমার্জেন্সি পিল নিয়ে ভয় বা লজ্জা নয়—বরং সঠিক তথ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব। আপনার শরীর, আপনার সিদ্ধান্ত—তবে সেটি যেন হয় জ্ঞানসম্মত ও দায়িত্বশীল।

সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন!

ধন্যবাদ! 💙

Scroll to Top